পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8¢ २ * রবীন্দ্র-রচনাবলী শচীশ’কহিল, সে যে ছিল ডাঙার উপরকার মুক্তি, তখন কাজের ক্ষেত্রে জ্যাঠামশায় আমার হাত-পাকে সচল করিয়া দিয়াছিলেন। আর এ যে রসের সমুদ্র, এখানে নৌকার বঁধেনই যে মুক্তির রাস্তা। তাই তো গুরু আমাকে এমন করিয়া চারি দিক হইতে সেবার মধ্যে আটকাইয়া ধরিয়াছেন ; আমি পা টিপিয়া পার হইতেছি । আমি বলিলাম, তোমার মুখে এ কথা মন্দ শোনায় না, কিন্তু যিনি তোমার দিকে এমন করিয়া পা বাড়াইয় দিতে পারেন তিনি— * শচীশ কহিল, তার সেবার দরকার নাই বলিয়াই এমন করিয়া পা বাড়াইয়া দিতে পারেন, যদি দরকার থাকিত তবে লজ্জা পাইতেন । দরকার যে আমারই । বুঝিলাম, শচীশ এমন একটা জগতে আছে আমি যেখানে একেবারেই নাই। মিলনমাত্র যে আমাকে শচীশ বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল সে আমি শ্ৰীবিলাস নয়, সে আমি সর্বভূতী ; সে আমি একটা আইডিয়া । এই ধরনের আইডিয়া জিনিসটা মদের মতো ; নেশার বিহবলতায় মাতাল যাকেতাকে বুকে জড়াইয় অশ্রুবর্ষণ করিতে পারে, তখন আমিই কী আর অন্যই কী । কিন্তু এই বুকে-জড়ানোতে মাতালের যতই আনন্দ থাক্‌, আমার তো নাই ; আমি তে৷ ভেদজ্ঞানবিলুপ্ত একাকারত-বন্যার একটা ঢেউমাত্র হইতে চাই না— আমি যে আমি । বুঝিলাম, তর্কের কর্ম নয়। কিন্তু শচীশকে ছাড়িয়া যাওয়া আমার সাপ্য ছিল না ; শচীশের টানে এই দলের স্রোতে আমিও গ্রাম হইতে গ্রামে ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে নেশায় আমাকেও পাইল ; আমিও সবাইকে বুকে জড়াইয় ধরিলাম, অশ্রীবর্ষণ করিলাম, গুরুর পা টিপিয়া দিতে লাগিলাম এবং একদিন হঠাৎ কী-এক আবেশে শচীশের এমন একটি অলৌকিক রূপ দেখিতে পাইলাম যাহা বিশেষ কোনো-একজন দেবতাতেই সম্ভব । & আমাদের মতো এতবড়ো দুটো দুর্ধর্ষ ইংরেজিওয়াল নাস্তিককে দলে জুটাইয় লীলানন্দ স্বামীর নাম চারি দিকে রটিয়া গেল । কলিকতাবাসী তার ভক্তের এবর র্তাকে শহরে আসিয়া বসিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল । তিনি কলিকাতায় আসিলেন । শিবতোষ বলিয়া তার একটি পরম ভক্ত শিষ্য ছিল । কলিকাতায় থাকিতে স্বামী তারই বাড়িতে থাকিতেন ; সমস্ত দলবল সমেত র্তাহীকে সেবা করাই তার জীবনের প্রধান আনন্দ ছিল।