৪৮২ | রবীন্দ্র-রচনাবলী শচীশ জলিতেছে, তার জীবনটা এক দিক হইতে আর-এক দিক পর্যস্ত রাঙা হইয় छेठेिल । l এতদিন সে নাচিয়া গাহিয়া কাদিয়া গুরুর সেবা করিয়া দিনরাত অস্থির ছিল, সে এক রকম ছিল ভালো। মনের সমস্ত চেষ্টা প্রত্যেক মুহূর্তে ফুকিয়া দিয়া একেবারে সে নিজেকে দেউলে করিয়া দিত। এখন স্থির হইয়া বসিয়াছে, মনটাকে আর চাপিয়া রাখিবার জো নাই। আর ভাবসম্ভোগে তলাইয়া যাওয়া নয়, এখন উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হইবার জন্য ভিতরে ভিতরে এমন লড়াই চলিতেছে যে তার মুখ দেখিলে ভয় হয় । আমি একদিন আর থাকিতে পারিলাম না ; বলিলাম, দেখো শচীশ, আমার বোধ হয় তোমার এক জন কোনো গুরুর দরকার যার উপরে ভর করিয়া তোমার সাধনা সহজ হইবে। শচীশ বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, চুপ করে বিস্ত্র, চুপ করো– সহজকে কিসের দরকার ? ফাকিই সহজ, সত্য কঠিন । * আমি ভয়ে ভয়ে বলিলাম, সত্যকে পাইবার জন্যই তো পথ দেখাইবার— শচীশ অধীর হইয়া বলিল, ওগো, এ তোমার ভূগোলবিবরণের সত্য নয়, আমার অন্তর্যামী কেবল আমার পথ দিয়াই আনাগোনা করেন— গুরুর পথ গুরুর আঙিনাতেই যাওয়ার পথ । 臺 এই এক শচীশের মুখ দিয়া কতবার যে কত উল্টা কথাই শোনা গেল। আমি শ্ৰীবিলাস, জ্যাঠামশায়ের চেলা বটে, কিন্তু তাকে গুরু বলিলে তিনি আমাকে চেলাকাঠ লইয়। মারিতে আসিতেন। সেই-আমাকে দিয় শচীশ গুরুর পা টিপাইয়া লইল, আবার ছু দিন না যাইতেই সেই আমাকেই এই বক্তৃতা ! আমার হাসিতে সাহস হইল না, গম্ভীর হইয়া রহিলাম । শচীশ বলিল, আজ আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মে ভয়াবহ: কথাটার অর্থ কী । আর সব জিনিস পরের হাত হইতে লওয়া যায়, কিন্তু ধর্ম যদি নিজের না হয় তবে তাহ মারে, বাচায় না। আমার ভগবান অন্যের হাতের মুষ্টিভিক্ষণ নহেন ; যদি তাকে পাই তো আমিই র্ত্যকে পাইব, নহিলে নিধনং শ্রেয়: | তর্ক করা আমার স্বভাব, আমি সহজে ছাড়িবার পাত্র নই ; আমি বলিলাম, যে কবি সে মনের ভিতর হইতে কবিতা পায়, যে কবি নয় সে অন্তের কাছ হইতে কবিতা নেয় । শচীশ অমান মুখে বলিল, আমি কবি।