পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8W28 রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশ্বজগতকে মনের মধ্যে আহরণ করিয়া আনিতে হয়, মনে করিতে হয়, আমি বিশ্বভুবনের অধিবাসী--- আমি কোনো বিশেষপ্রদেশবাসী নহি— আমি যে রাজ-অট্টালিকার মধ্যে বাসস্থান পাইয়াছি, লোকলোকান্তর তাহার এক-একটি কক্ষ । এইরূপে, যিনি যথার্থ আৰ্য, তিনি অন্তত প্রত্যহ একবার চন্দ্ৰসূৰ্য গ্ৰহতারকার মাঝখানে নিজেকে দণ্ডায়মান করেন, পৃথিবীকে অতিক্রম করিয়া নিখিল জগতের সহিত আপনার চিরসম্বন্ধ একবার উপলব্ধি করিয়া লন— স্বাস্থ্যুকামী যেরূপ রুদ্ধগৃহ ছাড়িয়া প্ৰত্যুষে একবার উন্মুক্ত মাঠের বায়ু সেবন করিয়া আসেন, সেইরূপ আৰ্য সাধু দিনের মধ্যে একবার নিখিলের মধ্যে, ভূর্তৃবঃস্বর্লোকের মধ্যে নিজের চিত্তকে প্রেরণ করেন। তিনি সেই অগণ্য জ্যোতিষ্কাখচিত বিশ্বলোকের মাঝখানে দাড়াইয়া কী মন্ত্র উচ্চারণ করেন তৎসবিতুৰ্বরেণ্যং ভর্গে দেবস্য ধীমহি। এই বিশ্বপ্রসবিতা দেবতার বরণীয় শক্তি ধ্যান করি । এই বিশ্বলোকের মধ্যে সেই বিশ্বলোকেশ্বরের যে শক্তি প্ৰত্যক্ষ, তাহাকেই ধ্যান করি । একবার উপলব্ধি করি বিপুল বিশ্বজগৎ একসঙ্গে এই মুহূর্তে এবং প্রতিমুহূর্তেই তাহা হইতে অবিশ্রাম বিকীর্ণ হইতেছে। আমরা যাহাকে দেখিয়া শেষ করিতে পারি না, জানিয়া অন্ত করিতে পারি না, তাহা সমগ্রভাবে নিয়তই তিনি প্রেরণ করিতেছেন। এই বিশ্বপ্রকাশক অসীম শক্তির সহিত আমার অব্যবহিত সম্পর্ক কী সূত্রে ? কোন সূত্র অবলম্বন করিয়া তীহাকে ধ্যান করিব ? ধিয়ো যো নঃ প্ৰচোদয়াৎ যিনি আমাদিগকে বুদ্ধিবৃত্তিসকল প্রেরণ করিতেছেন, তাহার প্রেরিত সেই ধীসূত্রেই তীহাকে ধ্যান করিব। সূর্যের প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষভাবে কিসের দ্বারা জানি ? সূর্য নিজে আমাদিগকে যে কিরণ প্রেরণ করিতেছেন, সেই কিরণেরই দ্বারা । সেইরূপ বিশ্বজগতের সবিতা আমাদের মধ্যে অহরহ যে ধীশক্তি প্রেরণ করিতেছেন— যে শক্তি থাকাতেই আমি নিজেকে ও বাহিরের সমস্ত প্ৰত্যক্ষব্যাপারকে উপলব্ধি করিতেছি— সেই ধীশক্তি তাহারই শক্তি— এবং সেই ধীশক্তিদ্বারাই তাহারই শক্তি প্রত্যক্ষভাবে অন্তরের মধ্যে অন্তরতমরূপে অনুভব করিতে পারি। বাহিরে যেমন ভুর্ভুবল্লম্বলোকের সবিতৃরূপে তাহাকে জগৎচরাচরের মধ্যে উপলব্ধি করি, অন্তরের মধ্যেও সেইরূপ আমার ধীশক্তির অবিশ্রাম প্রেরয়িতা বলিয়া তাহাকে অব্যবহিতভাবে উপলব্ধি করিতে পারি। বাহিরে জগৎ এবং আমার অন্তরে ধী, এ দুইই একই শক্তির বিকাশ, ইহা জানিলে জগতের সহিত আমার চিত্তের এবং আমার চিত্তের সহিত সেই সচ্চিদানন্দের ঘনিষ্ঠ যোগ অনুভব করিয়া সংকীর্ণত হইতে স্বাৰ্থ হইতে ভয় হইতে বিষাদ হইতে মুক্তিলাভ করি। এইরূপে গায়ত্রীমন্ত্রে বাহিরের সহিত অন্তরের, এবং অন্তরের সহিত অন্তরতমের যোগসাধন করে । ব্ৰহ্মকে ধ্যান করিবার এই যে প্রাচীন বৈদিক পদ্ধতি ইহা যেমন উদার, তেমনি সরল । ইহা সর্বপ্রকার-কৃত্রিমতা-পরিশূন্য ; বাহিরের বিশ্বজগৎ এবং অন্তরের ধী, ইহা কাহাকেও কোথাও অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে হয় না— ইহা ছাড়া আমাদের আর কিছুই নাই। এই জগতকে এবং এই বুদ্ধিকে র্তাহার অশ্রান্তশক্তি দ্বারা তিনিই অহরহ প্রেরণ করিতেছেন, এই কথা স্মরণ করিলে তাহার সহিত আমাদের সম্বন্ধ যেমন গভীরভাবে সমগ্রভাবে একান্তভাবে হৃদয়ংগম হয়, এমন আর কোন কৌশলে, কোন আয়োজনে, কোন কৃত্রিম উপায়ে, কোন কল্পনানৈপুণ্যে হইতে পারে, তাহা আমি জানি না। ইহার মধ্যে তর্কবিতর্কের কোনো স্থান নাই, মতবাদ নাই, ব্যক্তিবিশেষগত প্রকৃতির কোনো সংকীর্ণতা क्राष्ट्रि | আমাদের এই ব্ৰহ্মের ধ্যান যেরূপ সরল অথচ বিরাট, আমাদের উপনিষদের প্রার্থনাটিও ঠিক সেইরূপ । বিদেশীরা এবং তঁহাদের প্ৰিয়ছাত্র স্বদেশীরা বলেন, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্ৰ পাপের প্রতি প্রচুর মনোযোগ করে নাই, ইহাই হিন্দুধর্মের অসম্পূর্ণতা ও নিকৃষ্টতার পরিচয় - বস্তুত ইহাই হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ। আমরা পাপপুণ্যের একেবারে মূলে গিয়াছিলাম। অনন্ত আনন্দস্বরূপের সহিত চিত্তের