পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/১৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনারলী হইতেছে, গহে গহে বিজয়পতাকা উড্ডীন হইতেছে। প্রাতঃকালে জয়ঢাকের শব্দে রাজপতে সৈন্যগণ সজিত হইয়া রঙ্গস্থলে গমন করিতেছে, উদয়পুরের অধীনস্থ নানা স্থান হইতে অনেক সেনানী নিজ নিজ সৈন্য-সামন্ত লইয়া সমবেত হইয়াছে, নানাস্থানীয় লোকের নানারপে পরিচ্ছদ, নানারপ পতাকা ও নানারপে অস্ত্রশস্ত্ৰ আজি উদয়পরে সম্মিলিত হইতেছে। পঞ্চদশ সহস্ৰ যোদ্ধা আজি মহারাণাকে বেল্টন করিয়াছে, তাহাদিগের পদভরে যেন মেদিনী কম্পিত হইতেছে । বেলা এক প্রহর হইতে সন্ধ্যা পৰ্য্যস্ত রঙ্গস্থল সৈন্যে সমাকীর্ণ, এবং তাহাদিগের যুদ্ধকৌশল দেখিবার জন্য সমস্ত নগরবাসী ঝ:কিয়া পড়িয়াছে। রাণার আদেশে সৈন্যগণ তাঁরনিক্ষেপে বা বশাচালনে, খড়া-যুদ্ধে অথবা অশ্বচালনে, নিজ নিজ কৌশল দেখাইতে লাগিল, এবং মেওয়ারের নানা স্থান ও নানা দাগ হইতে আগত নানা কুলের রাজপতগণ নিজ নিজ রণনৈপুণ্য দশাইতে লাগিল। চন্দাওয়ৎকুল, জগাওয়ৎকুল, রাঠোরকুল, প্রমরকুল, ঝালাকুল প্রভৃতি নানা কুলের রাজপতগণ অদ্য উদয়পরে মহারাণার নিকট রাজভক্তি ও রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করিতে আসিয়াছে, এবং তাহাদিগের সব সব চারণগণ সেই সেই কুলের গৌরবসচক গীত গাইতেছে। নরেন্দ্র সমস্ত দিন এইরুপ সমরোৎসব দেখিয়া এবং চারণদিগের গীত শুনিয়া পুলকিত হইলেন। অদ্যাবধি রাজস্থানে শারদীয় পাজার শেষ দিনে এইরুপ ঘটা হয়, অদ্যাবধি রাজপত যোদ্ধাগণ এই সময়ে নিজ নিজ রাজার নিকট সমবেত হইয়া যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করে, অদ্যাবধি রাজপত নগরবাসিগণ দেবীপজার অবসানে রঙ্গস্থলে সমবেত হইয়া দেশীয় রাজভক্তি প্রদর্শন করে। বৰ্ত্তমান লেখক রাজস্থানে ভ্রমণকালীন শারদীয় খড়াপজা ও শারদীয় সমারোহ অবলোকন করিয়াছে, সহস্ৰ সহস্ৰ নগরবাসীদিগের সমাগম ও রাজভক্তি দটি করিয়াছে, প্রাচীন নিয়ম অনুসারে স্বাধীন রাজপতদিগের শরৎকালের আনন্দোৎসব দেখিয়া নয়ন তৃপ্ত করিয়াছে। সমস্ত দিন এইরুপ উৎসব দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ সন্ধ্যার সময় একটী বক্ষতলে যাইয়া কিছর ফলমল আহারের আয়োজন করিলেন, এবং নিকটস্থ একটী কাপ হইতে জল আনিতে গেলেন। কপের নিকট গোস্বামিবেশে একজন দণ্ডায়মান ছিলেন, তিনিও জল আনিতে গিয়াছিলেন। তিনি নরেন্দ্রকে কিঞ্চিৎ পর্ষভাবে ঠেলিয়া দিয়া আগে নিজে জল তুলিতে লাগিলেন। গোস্বামীর এই অভদ্রাচরণ দেখিয়া নরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইলেন এবং তিরস্কার করিলেন। গোস্বামী দ্বিগুণ কটভাষায় তিরস্কার করিয়া বলিলেন—তুমি বিদেশীয়, রাজস্থানে আসিয়া রাজপতেদিগের সহিত কলহ করিতে তোমার ভয় বোধ হয় না ? নরেন্দ্র। আমি বিদেশীয় বটে, কিন্তু বহুকাল অবধি রাজপতদিগের সহিত সহবাস করিয়াছি ; তোমার ন্যায় অভদ্র রাজপত দেখি নাই। গোস্বামী। যদি রাজপতিদিগের সহিত সহবাস করিয়া থাক, তাহা হইলে বোধ হয় জান যে রাজপত মাত্রেই অসি ও ঢাল চালাইতে জানে। অতএব চুপ করিয়া থাক। নরেন্দ্র। গব্বিত রাজপত, আমিও অসি ও ঢাল চালনায় কিছু শিক্ষা করিয়াছি, আমার নিকট গব্ব করিও না। তুমি গোস্বামী বলিয়া এবার ক্ষমা করিলাম। কথায় কথায় বিবাদ বাড়িতে লাগিল, গোস্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নরেন্দুকে প্রহার করিলেন, নরেন্দ্রও প্রহার করিলেন, অপেক্ষণে উভয়ে জ্ঞানশন্যে হইয়া অসি ও ঢাল বাহির করিলেন। তখন অন্ধকার হইয়াছে, সে স্থান হইতে আর সকলে চলিয়া গিয়াছে। দুইজনে একেবারে বেগে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, ক্ষণকাল তাহাদের কাহাকেও ভাল করিয়া দেখা গেল না। মহোত্তমধ্যে নরেন্দ্র পরাজিত হইলেন। সেই অপব্ব বলবান গোস্বামীর প্রচণ্ড আঘাতে নরেন্দ্রের ঢাল চর্ণ হইয়া গেল, নরেন্দ্রের অসি হস্ত হইতে পড়িয়া গেল, নরেন্দ্র স্বয়ং ভূমিতে নিপতিত হইলেন। তীব্রস্বরে গোস্বামী বলিলেন--বিদেশীয় যোদ্ধা, তুমি বালক, তোমার অপরাধ ক্ষমা করিলাম। পনেরায় রাজপতে গোস্বামীর সহিত কলহ করিও না, গোস্বামীর চিরজীবন কেবল পজোকায্যে অতিবাহিত হয় নাই, সেও যুদ্ধ ব্যবসা কিছ জানে। নরেন্দ্র ককশস্বরে বলিলেন-রাজপত! আমি তোমার নিকট জীবনভিক্ষা চাহি না । তোমার যাহা ইচ্ছা, যাহা সাধ্য কর, আমি অনুগ্রহ চাহি না। গোস্বামী তখন গম্ভীরস্বরে উত্তর করিলেন,—যোদ্ধা, আমিও যুদ্ধব্যবসা করিয়া থাকি, যোদ্ধার নিকট ভিক্ষা চাহিতে যোদ্ধার কোন অপমান নাই। নরেন্দ্র, আমি তোমাকে জানি, তুমিও ૪.૨૨