পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৪০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংসার হইতেছে; কখন অসলারের দোকান হইতে সে সন্ধা প্রতিফলিত হইতেছে, জগৎ তাহার কিরণে আলোকপণ হইতেছে! আর কখনও বা অবারিত বেগে কর্তৃপক্ষদিগের মহল হইতে সে অমতস্রোত প্রবাহিত হইতেছে, যাবতীয় বড়লোকগণ, সমাজের সমাজপতিগণ, ভারি ভারি দেশের মহামান্যগণ, পরম সখে তাহাতে অবগাহন করিতেছেন, হাবড়ুব খাইতেছেন, আপনাদিগের জীবন সাথক মনে করিতেছেন! আবার কখনও বা বিলাত হইতে “পেক” করা “হমোটকিলীসীল” করা বাক্সে বাক্সে সে মাল আমদানি করা হইতেছে, দই একখানি ফাঁপা বা গিলটি করা দ্রব্যের সহিত রাশি রাশি চাটকারিতা বিমিশ্রিতা করিয়া বিলাতী মহাজনের মন ভুলাইয়া দেশীয় বিজ্ঞগণ সে মাল আমদানি করিতেছেন। এ বাজারে সে মালের দর কত! “আদত বিলাতী সম্মানসচক পত্র !" "আদত বিলাতী সম্মানসচক পদবী "–এই গৌরবধবনিতে বাজার গলজার হইতেছে! বিস্তীর্ণ বাজারের অন্য কোথাও "দেশহিতৈষিতা", "সমাজ সংস্কার” প্রভৃতি বিলাতী মাল বিলাতী দরে বিক্রয় হইতেছে, সে হাটে বড়ই গোলমাল, বড়ই লোকের ঠেলাঠেলি, বড়ই লোকের কোলাহল, তাহাতে কলিকাতার টাউনহল, কৌনসিল-হল, মিউনিসিপাল-হল প্রভৃতি বড় বড় অট্টালিকা বিদীণ হইতেছে। হেমচন্দ্র দেখিলেন, রাজমিসত্রী অনবরত মেরামত করিয়াও সেসব বাড়ী রাখিতে পারিতেছে না, দেয়াল ও ছাদ ফাটিয়া গিয়া সে কোলাহল গগনে উত্থিত হইতেছে, সমস্ত ভারতবর্ষে প্রতিধননিত হইতেছে। আবার সে হাটের ঠিক সম্মুখে অন্যরাপ মাল বিক্রয় হইতেছে, বিক্রেতৃগণ বড় বড় জয়ঢাক বাজাইয়া চীৎকার করিতেছে—আমাদের এ খাঁটী দেশী মাল, ইহার নাম “সমাজ-সংরক্ষণ", ইহাতে বিলাতী মালের ভেজাল নাই, সকলে একবার চাকিয়া দেখ। হেমচন্দ্র একট চাকিয়া দেখিলেন, দেখিলেন, মালটা ষোল আনা বিলাতী, বিলাতী পাত্রে বিক্ৰীত, বিলাতী মালমসলায় প্রস্তুত, কেবল একটু দেশী ঘিয়ে ভাজিয়া লওয়া মাত্র। হেমচন্দ্র দরিদ্র হইলেও লোকটা একটা সৌখিন, তাঁহার বোধ হইল, ঘিটাও দরগান্ধ! ভাল খাঁটি দেশী ঘি নহে। ঈষৎ পচা, ও সেই ঘিয়ে ভাজা গরম গরম এই “প্রকৃত দেশী মাল” বিক্রয় হইতেছে। রাশি রাশি খরিদদার হাটের দিকে ধাইতেছে। সের দরে, মণ দরে, হাঁড়ি করিয়া, জালায় করিয়া, সেই মাল বিক্রয় হইতেছে। মটেরা রাশি রাশি মাল বহিয়া উঠিতে পারিতেছে না, তাহার সৌরভে সহর আমোদিত হইতেছে! তাহার পর সাধত্বের বাজার, বিজ্ঞতার বাজার, পাণ্ডিত্যের বাজার, হেমচন্দ্র কত দেখিবেন ? সে সামান্য পাণ্ডিত্য নহে, অসাধারণ পান্ডিত্য : এক শাস্ত্রে নহে, সব্ব শাস্ত্রে; এক ভাষায় নহে, সকল ভাষায় ; এক বিষয়ে নহে, সকল বিষয়ে : কম বেশী নহে, সকল বিষয়েই সমান সমান; অলপ পরিমাণে নহে, সের দরে, মণ দরে, জালায় জালায় পাণ্ডিত্য বিকাশিত রহিয়াছে। সে গাঢ় পাণ্ডিত্যের ভারে দই একটী জালা ফাঁসিয়া গেল, পথঘাট পাণ্ডিত্যের লহরীতে কদ্দমময় হইল, পিপীলিকা ও মধ্যমক্ষিকার দল ঝাঁকে ঝাঁকে আসিল, হেমচন্দ্র আর দাঁড়াইতে পারিলেন না, সেই পাণ্ডিত্যের উৎস হইতে নাকে কাপড় দিয়া ছটিয়া পলাইলেন। তাহার পর ধমের বাজার, যশের বাজার, পরোপকারিতাব বাজার, হেমচন্দ্ৰ দেখিয়া শুনিয়া বিস্মিত হইলেন। কলিকাতার কি মাহাত্ম্য! এমন জিনিসই নাই, যাহা খরিদ-বিক্রয় হয় না। যাহাতে দুই পয়সা লাভ আছে, তাহারই একখানা দোকান খোলা হইয়াছে, মাল গদামজাত হইয়াছে, মালের গুণাগণে যাহাই হউক, একখানি জমকাল “সাইন বোড" সম্মখে দশকদিগের নয়ন ঝলসিত করিতেছে! বাল্যকালে তিনি বড়বাজারের বণিকদিগকে চতুর মনে করিতেন, কিন্তু অদ্য এ বাজারের চতুরতা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, চতুরতায় জিনিসের কাটতি, চতুরতায় বিশেষ মনোফা, চতুরতায় জগৎসংসার ধাঁধা লাগিয়া রহিয়াছে ! কলিকাতায় অনেক দিন থাকিতে থাকিতে হেমচন্দ্র সময়ে সময়ে অলপ পরিমাণে খাঁটি মালও দেখিতে পাইলেন। কখন কোন ক্ষুদ্র দোকানে বা অন্ধকার কুটীরে একট খাঁটি দেশহিতৈষিতা, একটা খাঁটি পরোপকারিতা, একট খাঁটি পাণ্ডিত্য পাইলেন, কিন্তু সে মাল কে চায়, কে জিজ্ঞাসা করে ? কলিকাতার গৌরবান্বিত বড়বাজারে সে মালের আমদানি রপ্তানি বড় অলপ, সসভ্য মহাসম্প্রান্ত ক্রেতাদিগের মধ্যে সে মালের আদর অতি অলপ। ○や○。