পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৪০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : ছেলে-মুখে বড়ো কথা আষাঢ় মাসে বর্ষাকাল আরম্ভ হইল, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইল, হেমচন্দ্রের ভবিষ্যৎ আকাশও মেঘাচ্ছন্ন হইতে লাগিল। তিনি কলিকাতায় কোনও কায্যের জন্য বিশেষ লালায়িত নহেন, কিছ না হয়, ছয় মাস পরে গ্রামে ফিরিয়া যাইবেন, পাবেই স্থির করিয়াছিলেন; তথাপি যখন কলিকাতায় কমের চেন্টায় আসিয়াছেন, তখন কম পাইবার জন্য যত্নের ত্রুটি করিলেন না। কিন্তু এ পৰ্য্যস্ত তিনি কোন উপায় করিতে পারেন নাই। তাঁহার চারিদিকে কলিকাতার অনন্ত লোক-স্লোত অনবরত প্রবাহিত হইতেছে, এই অনন্ত জনসমুদ্রের মধ্যে হেমচন্দ্র একাকী ! জন্য জলখাবার প্রস্তুত করিয়া রাখিতেন, দুখানি আক, দটি পানফল, চারটী মগের ডাল, এক গেলাস মিছরীপানা সযত্নে আনিয়া দিতেন, প্রফুল্লচিত্তে মিন্ট বাক্য দ্বারা হেমচন্দ্রের শ্রান্তি দর করিতেন। পল্লীগ্রামেও যেরপে, ভবানীপুরেও সেইরূপ, বামিসেবাই বিন্দর একমাত্র কম, ছেলে দুইটী মানুষ করাই তাঁহার একমাত্র আনন্দ। সেই কায্যে প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পয্যন্ত ব্যস্ত থাকিতেন, সন্ধ্যার সময় শিশু দুইটীকে লইয়া ছাদে গিয়া বসিতেন, কখন কখন দেশের চিন্তা করিতেন, কখন কখন ছাদের প্রাচীরের গবাক্ষের ভিতর দিয়া পথের জনস্রোত দেখিতেন । তাঁহার শরীর পকেবাপেক্ষা একট ক্ষীণ, তাঁহার মলান মুখমণ্ডল পবোপেক্ষা একট অধিক মলান ! প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় শরৎ হেমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন। বিন্দর শয়নঘরে প্রদীপ জালিয়া একটী মাদর পাতিয়া দিতেন, সকলে সেই স্থানে উপবেশন করিয়া অনেক রাত্ৰি পৰ্য্যস্ত কথাবাত্ত কহিতেন। হেমচন্দ্র কলিকাতায় যাহা যাহা দেখিতেন, তাহাই বলিতেন: শরৎ কলেজের কথা, পুস্তকের কথা, শিক্ষক বা ছাত্রদিগের কথা, কলিকাতার নানা গল্প, নানা কথা, সংসারের সখেদঃখের কথা, জগতে ধন ও দারিদ্র্যের কথা অনেক রাত্রি পয্যন্ত কহিতেন। তাহার নবীন বয়সের উৎসাহ, ধৰ্ম্মপরায়ণতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সেই কথায় দেদীপ্যমান হইত, জগতের প্রকৃত মহৎ লোকের উৎসাহ, মহত্ত্ব ও অবিচলিত প্রতিজ্ঞার গলপ করিতে করিতে শরচ্চন্দ্রের শরীর কণ্টকিত হইত, জগতের প্রতারণা মিথ্যাচরণ অত্যাচারের কথা কহিতে কহিতে সেই যুবকের নয়নদ্বয় প্রজদলিত হইত। হেমচন্দ্র জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্নেহের সহিত সেই উন্নতহদয় যুবকের কথা শুনিয়া অতিশয় তুস্ট ও প্রীত হইতেন, বিন্দ বাল্যসহদের হৃদয়ের এই সমস্ত উৎকৃষ্ট চিন্তা ও ভাব দেখিয়া পুলকিত হইতেন এবং মনে মনে শরতের ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতেন ; বালিকা সন্ধা নিদ্রা ভুলিয়া যাইত, একাগ্রচিত্তে সেই যুবকের দীপ্ত মুখমন্ডলের দিকে চাহিয়া থাকিত ও তাহার অমত ভাষা শ্রবণ করিত। শরতের তেজঃপণে গল্পগুলি শুনিয়া বালিকার হৃদয় হষ ও উৎসাহে পাণ হইত, হেমচন্দ্র কলিকাতায় যাহা যাহা দেখিতেন, সে কথা সৰ্ব্বদাই সন্ধ্যার সময় গল্প করিতেন। একদিন কলিকাতার “বড়বাজারের” মাহাক্সোর কথা বর্ণনা করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “শরৎ! দেশহিতৈষিতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি সদগুণগুলি মনুষ্য-হৃদয়ের প্রধান গণ তাহার সন্দেহ নাই, কিন্তু এই সদগণগুলির নামে তোমাদের কলিকাতায় যে রাশি রাশি প্রতারণাকাৰ্য্য হয়, তাহাতে বিস্মিত হইয়াছি। আমাদের পল্লীগ্রামে প্রকৃত স্বদেশহিতৈষিতা বিরল, তাহা আমি স্বীকার করি, কিন্তু স্বদেশহিতৈষিতার আড়ম্ববরও বিরল!” শরৎ । আপনি যাহা বলিলেন, তাহা সত্য, বড় বড় সহরেই বড় বড় প্রতারণা, কিন্তু আপনি কি প্রকৃত সদগণ কলিকাতায় পান নাই: প্রকৃত দেশহিতৈষিতা, সত্যাচরণ, বিদ্যানরোগ, যশোলিপসা প্রভৃতি যে সমস্ত সদগণ মনুষ্য-হৃদয়কে উন্নত করে, সেগুলি কি আপনি দেখেন নাই ? হেম। শরৎ, তাহা আমি বলি নাই, বরং কলিকাতায় সেরাপ অনেক সদগণে দেখিয়া আমি তৃপ্ত হইয়াছি। কলিকাতায় যে প্রকৃত দেশানরোগ দেখিয়াছি, স্বদেশীয়দিগের হিতসাধন জন্য যেরপ অনন্ত চেষ্টা, উদ্যম, জীবনব্যাপী উৎসাহ দেখিলাম, এরপ পল্লীগ্রামে কখনও দেখি ○ り げ