পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬ রোকেয়া রচনাবলী

তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না—“পিপাসা, পিপাসা”? উহাতে কি একটা হৃদয়বিদারক শোকস্মৃতি জাগিয়া উঠে না? সকল মানুষই মরে বটে কিন্তু এমন মরণ কাহার হয়?[১]

 একদিন স্বপ্নে দেখিলাম—স্বপ্নে মাত্র যেন সেই কারবালায় গিয়াছি। ভীষণ মরুভূমি তপ্ত বালুকা; চারিদিক ধূ ধূ করিতেছে; সমীরণ হায় হায় বলিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন কাহাকে খুঁজিতেছে! আমি কেবল শুনিতে পাইলাম—“পিপাসা, পিপাসা”! বালুকা কণায় অঙ্কিত যেন “পিপাসা, পিপাসা”! চতুর্দিক চাহিয়া দেখিলাম, সব শূন্য, তাহার ভিতর ‘পিপাসা” মূর্তিমতী হইয়া ভাসিতেছে।

 সে দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর—তথা হইতে দূরে চলিলাম। এখানে যাহা দেখিলাম, তাহা আরও ভীষণ, আরও হৃদয়বিদারক! দেখিলাম মরুভূমি শোণিত-রঞ্জিত![২] রক্তপ্রবাহ বহিতে


  1. একদা জয়নাল আবদীন (হোসেনের পুত্র) জনৈক কসাইকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছাগল জবেহ করিতে আনিয়াছ, উহাকে কিছু খাওয়াইয়াছ? কসাই উত্তর করিল, “হ্যাঁ, ইহাকে এখনই প্রচুর জলপান করাইয়া আনিলাম!” ইহা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “তুমি ছালটাকে প্রচুর জ্বলপানে তৃপ্ত করিয়া জবেহ করিতে আনিয়াছ; আর শিমর আমার পিত্রাকে তিন দিন পর্যন্ত লাভাবে পিপাসায় দগ্ধ করিয়া জবেহ করিয়াছে!!
    কারবালার যুদ্ধের সময় জয়নাল রাগে ভুগিতেছিলেন বলিয়া শহীদ (সমরশায়ী) হন নাই।
  2. ধর্ম্মগুরু মহাত্মা মোহাম্মদের (দঃ} মৃত্যুর পর, ক্রমান্বয়ে আবুবকর সিদ্দিক, ওমর খেতাব ও ওসমান গনি “খলিফা” হইলেন। চতুর্থবারে আলী খলিফা হইবেন, কি মোয়াবীয়া খলিফা হইবেন, এই বিষয়ে মতভেদ হয়। একদল বলিল, “মোয়াবীয়া হইবেন,” একদল বলে, “আলী মোহাম্মদের (দঃ) জামাতা, তিনি সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী”। এইরূপে বিবাদের সূত্রপাত হয়।
    অতঃপর মোয়াবীয়ার পুত্র এজিদ, আলীর পুত্র হাসান ও হোসেনের সর্বনাশ করিতে বদ্ধপরিকর হইল। এজিদ মহাত্মা হাসানকে কৌশলে বিষ পান করাইয়া হত্যা করে। ইহার এক বৎসর পরে মহাত্মা হোসেনকে ডাকিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া কারবালায় লইয়া গিয়া যুদ্ধে বধ করে। কেবল যুদ্ধ নহে—এজিদের দলবল ইউফ্রেীজ নদী ঘিরিয়া রহিল; হোসেনের পক্ষের কোন লোককে নদীর জল লইতে দেয় নাই। পানীয় জলের অভাবেই তাহারা আধমরা হইয়াছিলেন। পরে যুদ্ধের নামে একই দিন হোসেন আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হইলেন। এ কথায় মতভেদ আছে; কেহ বলেন, তিন দিন যুদ্ধ হয়, কেহ বলেন একই দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে সমশায়ী হইয়াছেন। নদীর জল হইতে হোসেনকে বঞ্চিত করিয়া এজিদ আঁশেষ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করিয়াছে।
    অষ্টাদশ বর্ষীয় নবীন যুবক কাসেম (হাসানের পুত্র) মৃত্যুর পূর্ব রাত্রে হোসেনের কন্যা সকিনাকে বিবাহ করেন! কারবালা যখন সকিনাকে নববধূ বেশে দেখিল, তাহার কয় ঘণ্টা পরেই তাহাকে নববিধবা বেশে দেখিয়াছিল। যেদিন বিবাহ, সেই দিনই বৈধব্য! হায় কারবাল! এ দৃশ্য দেখার চেয়ে অন্ধ কেন হও নাই? পুরুষণ ত যুদ্ধ করিতেছিলেন, আর ললনাগণ কি করিতেছিলেন?—একজনের জন্য শোক করিতেছিলেন, আর একটির সমরশায়ী হওয়া সংবাদ পাইলন!—কাসেমের জনা কঁদিতেছিলেন, আলী আকবরের মৃতদেহ পাইলেন! শোকোজ্জ্বাস কাসেমকে ছাড়িয়া আকবরের দিকে ধাবিত হইল, আকবরের মাথা কোলে লইয়া কাঁদিতেছিলেন, শিশু আসগরকে শরবিদ্ধ অবস্থায় প্রাপ্ত হইলেন! এক মাতৃ-হৃদয়—আকবরকে কোল হইতে নামাইয়া আসারকে কোলে লইল—ক সহ্য হয়? পুত্রশোকে আকুলা আছেন, কিছুক্ষণ পরে সর্বস্বধন হোসেনের ছিন্ন মস্তক (শত্রু উপহার পাঠাইল পাইলেন, তাই দেখিতেছেন, ইতোমধ্যে (হোসেনের কন্যা) বালিকা ফাতেমা পিতার মাথা দেখিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল, শহরবানু তাহার জন্য সান্ত্বনার উপায় খুঁজিতেই ছিলেন—ফাতেমার শ্বাসরোধ হইল! ক্ষুধায়