পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ৭

পারে নাই—যেমন রক্তপাত হইয়াছে, অমনি পিপাসু মরুভূমি তাহা শুযিয়া লইয়াছে। সেই সব রেখায় লেখা—“পিপাসা, পিপাসা”।

 নবীন যুবক আলী আকবর হােসেনের পুত্র যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়া পিতার নিকট পিপাসা নাইতে আসিয়া কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন “আল-আৎশ! আল-আংশ!!” (পিপাসা, পিপাসা! ঐ দেখ, মহাত্মা হােসেন স্বীয় রসনা পুত্রকে চুষিতে দিলেন, যদি ইহাতে তাহার কিছুমাত্র তৃপ্তি হয়! কিন্তু তৃপ্তি হইবে কি,—সে রসনা যে শুদ্ধ—নিতান্ত শুষ্ক! যেন দিক দিগন্তর হইতে শব্দ আসিল,—“পিপাসা পিপাসা”।

 মহাত্মা হােসেন শিশুপুত্র আলী আসগরকে কোলে লইয়া জল প্রার্থনা করিতেছেন। ৩াহার কথা কে শুনে? তিনি দীন নয়নে আকাশপানে চাহিলেন, “আকাশ মেঘশূন্য লি, নিতান্তই নির্ম্মল! তিনি নিজের কষ্ট,জল পিপাসা অম্লান বদনে সহিতেছেন। পরিজনকে সান্ত্বনা বাক্যে প্রবােধ দিয়াছেন। সকিনা প্রভৃতি বালিকারা জল চাহে না—তাহারা


    পিপাসায় কাতর বালিকা কত সহিবে? হঠাৎ প্রাণত্যাগ করিল! শহরবানু এখন সকিনার অশ্রু মুছাইবেন, না ফাতেমাকে কোলে লইবেন?
    আহা! এত যে কেহই সহিতে পারিবে না! আমার শােকসন্তপ্ত পূত্র-শাকাতুর ভগিনীমণি তােমরা একবার শহরবানু ও জয়নবের শােকরাশির দিকে দৃষ্টিপাত কর। তােমরা একজনের শােকেই বিহ্বল হও —দশদিক অন্ধকার দেখ! আর এ যে শােকসমূহ আঘাতের উপর আঘাত। তোমরা এক সময় এক ক্রনের বিরহে প্রাণ ভরিয়া দিতে পার, তাহাদের সে অবসর ছিল না! এক জয়ন কি করিবেন বল, নিজের পুত্রের জন্য কাদিবেন, না প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রদের দিকে চাহিবেন, না সব ছাড়িয়া ভ্রাতা হােসেনের ক্ষত ললাটখানি অশ্রুধারায় ধুইবেন? সেখানে অশ্রু ব্যতীত আর জল ত ছিল না।
    ধীরহৃদয়! একবার হােসেনের বীরতা সহিষ্ণুতা দেখ! ঐ দেখ, তিনি নদীবক্ষে দাড়াইয়া আর কোন যােদ্ধা নাই, সকলে সমরশায়ী, এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। তিনি কোন মতে পথ পরিষ্কার করিয়া নদী পর্যন্ত গিয়াছেন। ঐ দেখ অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিলেন, বুঝি পান করেন; না, পান ত করিলেন না!—য জলের জন্য আর তাঁহারই কোলে প্রাণ হারাইয়াছে, আকবর তাঁহার রসনা পর্যন্ত চুষিয়াছেন—সেই জল তিনি পান করিবেন? না,—তিনি জ্বল তুলিয়া দেখিলেন, ইচ্ছা করিলে পান করিতে পারেন। কিন্তু তাহা না করিয়া নদীর জল নদীতেই নিক্ষেপ করিলেন। বীরের উপযুক্ত কাজ!!
    মহরমের সময় সুন্নি-সম্প্রদায় শিয়ালে আমাদের জন্য যােগ দেয় না। একথা যে বলে, তাহার ভুল, -শােচনীয় ভুল। আলী ও তদীয় বংশধরগণ উভয় সম্প্রদায়েরই মান্য ও আদরণীয়। র্তাদের শােচনীয় মৃত্যু স্মরণ সময়ে কোন্ প্রাণে সুন্নিগণ আমােদ করিবে? আমােদে করে লকদল, সহৃদয় সূন্নিদল মহরমকে উৎসব বলে না।
    শিয়াদের বাহ্য আড়ম্বর সুন্নিগণ ভাল মনে করেন না। বক্ষে করাঘাত করিলে বা শেক-বস্ত্র পরিধান করিলেই যে শােক করা হইল, সুন্নিদের এরূপ বিশ্বাস নহে। মতভেদের কথা এই যে, শিয়াণ হজরতা আয়ষা—ফাতেমার বিমাতা সিংহাসন আলীকে না দিয়া মােয়াবীয়াকে দিয়াছেন বলিয়া আয়ষাকে নিন্দা করে। আমরা আয়ষার (আলীর সংশাশুড়ী হওয়া ব্যতীত আর কোন দোষ দেখি না। চতুর্থ খলিফা কে হইবেন, ধর্ম্মগুরু মােহাম্মদ (দঃ) তাহার নাম স্পষ্ট না বলিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়াছেন। সে নির্দিষ্ট ব্যক্তি মােয়াবীয়া কিম্বা আলী তাহারা উভয়ে একই স্থানে দণ্ডায়মান ছিলেন। এই মতভেদ হইল। কেহ বলিল “চতুর্থ খলিফা মােয়াবীয়া, কেহ বলিল “আলী"।
    আয়ষা হিংসা করিয়া বলেন নাই, সিংহাসন মােয়াবীয়া পাইবেন। তিনি ঐ অনুমানের কথাই বলিয়াছিলেন মাত্র। সুন্নিগণ মাননীয়া আয়ষার নিন্দা সহ্য করিতে পারেন না। শিয়া সুন্নিতে এইটুকু কথার মতভেদ। এই বিষয় লইয়াই দলাদলি।