পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০ রোকেয়া রচনাবলী
১০

সে সময় হয় ত তাহার শরীরে অনুভব শক্তি ছিল না, নচেৎ অত গরম পেয়ালা ও কোমল হাস্তে সহিবে কেন? আট বৎসরের শিশু—শনীর পুতুল, তাহার হাতে গরম পেয়ালা!—আর সেই তপ্ত চা-স্বাস্থ্য ভাল থাকিলে নিশ্চয় গলায় ফোস্কা হইত। আর ঐ মাখন-গঠিত কচি হাত দুটি জ্বলিয়া গলিয়া যাইত!! সেই চা তাহার শেষ পথ্য—আর কিছু খায় নাই।

 আক্ষেপ এই যে, জল কেন দিলাম না। রোগ সারিবার আশায় জল দিতাম না।—রোগ যদি না সারিল, তবে জল কেন দিলাম না? এই জন্যই ত রাত্রি দিন শুনি,—“পিপাসা, পিপাসা”! ঐ জন্যই ত এ নরকযন্ত্রণা ভোগ করি! আর সেই গরম চা’র পেয়ালা চক্ষের সম্মুখ ঘুরিয়া বেড়ায়, হৃদয়ে আঘাত করে, প্রাণ দগ্ধ করে! চক্ষু মুদ্রিত করিলে দেখি— অন্ধকারে জ্যোতির্ময় অক্ষরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”।

 নিশীথ সময়ে গৃহছাদে উঠিলাম। আকাশমণ্ডল পরিষ্কার ছিল কোটী কোটী তারকা ও চন্দ্র হীরক প্রভায় জ্বলিতেছিল। আমার পোড়া চক্ষে দেখিলাম—ঐ তারকা—অক্ষরে লেখা “পিপাসা, পিপাসা”। আমি নিজের পিপাসা লইয়া ব্যস্ত, তাহাতে আবার বিশ্বচরাচর পিপাসা দেখায়—পিপাসা শুনায়। বোধ হয় নিজের পিপাসার প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই মাত্র, আর কেহ পিপাসী নহে। অথবা এ বিশ্বজগৎ সত্যই পিপাসু!

 কুসুমকাননে আমি কি দেখিতে পাই? কুসুম হেলিয়া দুলিয়া বলে “পিপাসা, পিপাসা” লতায় পাতায় লেখা “পিপাসা, পিপাসা”! কুসুমের মনোমোহিনী মৃদু হাসি আমি দেখি না। আমি দেখি, কুমুদের সুধাংশু-পিপাসা॥

 বিহগ কুজনে আমি কি শুনিতে পাই? ঐ “পিপাসা, পিপাসা”। ঐ একই শব্দ নানাসুরে নানাৱাগে শুনি,—প্রভাতে ভৈরবী, নিশীথে বেহাগ—কিন্তু কথা একই। চাতক পিপাসায় কাতর হইয়া ডাকে—“ফটিক জল”। কোকিল ডাকিয়া উঠে “কুহু” ঐ কুহুস্বরে শত প্রাণের বেদনা ও হৃদয়ের পিপাসা ঝরে! এ কি, সকলে আমাকে পিপাসার ভাষা শুনায় কেন? আহা! আমি কোথায় যাই? কোথায় যাইলে “পিপাসা” শুনিব না?

 চল হৃদয়, তৃর নদী তীরে যাই,—সেইখানে হয় ত “পিপাসা” নাই। কিন্তু ঐ শুন! স্নিগ্ধসলিলা গঙ্গা কুলকুল স্বরে গাহিতেছে। “পিপাসা, পিপাসা” আপন মনে গাহিয়া বহিয়া যাইতেছে! একি স্বয়ং জল, তোমার আবার পিপাসা কেমন? উত্তর পাইলাম, “সাগরপিপাসা”। আহা! তাই ত, সংসারে তবে সকলেই পিপাসু? হইতে পারে, সাগরের—যাহার চরণে, জাহ্নবি! তুমি আপনার প্রাণ ঢালিতে যাইতেছে, তাহার পিপাসা নাই। তবে দেখা যাউক।

 একদিন সিন্ধুতটে সিক্ত বালুকার উপর বসিয়া সাগরের তরঙ্গ গণনা করিতেছিলাম। ঊর্মিমালা কি যেন যাতনায়, কি যেন বেদনায় ছটফট করিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া আছাড়িয়া। পড়িতেছিল। এ অস্থিরতা, এ আকুলতা কিসের জন্য? সবিস্ময়ে সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:

তব ওই সচঞ্চল লহরীমালায়
কিসের বেদনা লেখা?—পিপাসা জানায়।