পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ৯

বিভূষিত হইয়া—যাইতেছি শুন্য হৃদয়ে। তবে এখন শেষ বিদায় দাও! একটি কথা কও, তবে যাই! একটিবার চক্ষু মেলিয়া দেখ—আমাদের দুরবস্থা দেখ, তবে যাই!” জয়নবের দুঃখে সমীরণ হায় হায় বলিল,—দুর দুরান্তরে ঐ হায় হায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল।

 এখন আর স্বপ্ন নাই—আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। দূরে শৃগালের কর্কশ শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”! একি, আমি পাগল হইলাম নাকি? কেবল “পিপাসা দেখি কেন। কেবল “পিপাসা” শুনি কেন?

 আমার প্রিয়তমের সমাধিস্থানে যাইলাম। বনপথ দিয়া যাইতে শুনিলাম, তরুলতা বলে “পিপাসা, পিপাসা”! পত্রের মর্ম্মর শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”। প্রিয়তমের গাের হইতে শব্দ আসিতেছিল—“পিপাসা, পিপাসা”! ইহা অতি অসহ্য! প্রিয়তম মৃত্যুকালে জল পায় নাই—চিকিৎসকের নিষেধ ছিল। সুতরাং পিপাসী মরিয়াছে।

 আহা! এমন ডাক্তারী কে রচনা করিয়াছেন? রােগীর প্রতি (রােগ বিশেষে) জল-নিষেধ ব্যবস্থা কোন হৃদয়হীন পাষাণের বিধান? যখন রােগীকে বাচাইতে না পার, তখন প্রাণ ভরিয়া পিপাসা মিটাইয়া স্ক্রল পান করতে দিও। সে সময় ডাক্তারের উপদেশ শুনিও না। নচেৎ আমারই মত আজীবন পিপাসায় দগ্ধ হইবে।

 কোন রােগী মৃত্যুর পূর্বদিন বলিয়াছিল, “বাবাড্রান! তোমারই সােব্রাহির জল দাও। রােগী জানে, তাহার পিতার সােরাহির জল অবশ্যই শীতল হইবে পিতা তাহার আসন্নকাল জানিয়া স্বহস্তে সােরাহি আনিয়া দিলেন। অন্যান্য মিত্ররূপী শত্রুগণ তাহাকে প্রচুর জল সাধ মিটাইয়া পান করিতে দেয় নাই। ঐ রােগীর আত্ম কি আজ পর্যন্ত কারবালার শহীদদের মত “পিপাসা, পিপাসা” বলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় না? না; স্বর্গসুখে পিপাসা নাই। পিপাসা—যে বাচিয়া থাকে,তাহারই! অনন্তু শান্তি নিদ্রায় যে নিদ্রিত হইয়াছে, পিপাসা তাহার নহে! পিপাসা—যে পােড়া স্মৃতি লইয়া জাগিয়া থাকে,—তাহারই!!

 কিন্তু কি বলিতে কি বলিতেছি,~~-আমার হৃদয়ানন্দ মৃত্যুর পূর্বদিন গােপনে জননীর নিকট জল চাহিয়াছিল। ডাক্তারের নিষেধ ছিল বলিয়া কেহ তাহাকে জল দিত না। জননী ভয়ে ভয়ে অল্প জল দিয়াছিলেন। মৃত্যুকালে সে তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর ও অধীর হইয়াছিলহায়! না জানি সে কেমন পিপাসা!

 হৃদয়ানন্দ জানিত, আমি তাহাকে জল দিব না। আমি চিকিৎসকের অন্ধ আজ্ঞাবহ দাস, তাহাকে জল দিব না। তাই সে আমার উপস্থিত থাকা সময় জল চাহিতে সাহস করে নাই! কি মহতী সহিষ্ণুতা! জলের পরিবর্তে চা চাহিল। শীতল জলের পিপাসায় গরম চা!! চা তখনই প্রস্তুত হইয়া আসিল। যে ব্যক্তি চা পান করাইতেছিল, সে চা’র পেয়ালার কড়া ধরিতে পারিতেছিল না—পেয়ালা এত তপ্ত ছিল। আর সেই পিপাসী সে পেয়ালাটি দুই হস্তে (যেন কত আদরের সহিত জড়াইয়া ধরিয়া চা পান করিতে লাগিল!! আহা! না জানি সে কেমন পিপাসা!! অনলরচিত পিপাসা!! কিম্বা গরলরচিত পিপাসা!!!