পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২ রোকেয়া রচনাবলী

কারণ বশতঃ মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানাবিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধম্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।

 আমাদের এ বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেই বলিতে পারেন কি? সম্ভবতঃ সুযােগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতি সুবিধা না পাইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য্য হইতে অবসর লইয়াছে। এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্ম্মণ্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল! ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশী সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকম্মণ্য হইতে লাগিল। এদেশের ভিক্ষুদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে। একদিকে ধনাঢ্য দানবীরগণ ধর্ম্মোদ্দেশ্যে যতই দান করিতেছেন, অন্যদিকে ততই অধম ভিক্ষুসংখ্যা বাড়িতেছে! ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটা লজ্জাজনক বােধ করে না।

 ঐরূপ আমাদের আত্মদর লােপ পাওয়ায় আমরা অনুগ্রহ গ্রহণে আর সঙ্কোচ বােধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের,—প্রকারান্তরে পুরুষের—দাসী হইয়াছি। ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে। এবং আমরা বহু কাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বােধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না। কাজেই পুরুষজাতি বলিতে সুবিধা পাইয়াছেন:

 "The five worst maladies that afflict the female mind are: indocility, discontent, slander, jealousy and silliness... such is the stupidity of her character, that it is incumbent on her, in every particular, to distrust herself and to obey her husband." (Japan, the Land of the Rising Sun)

 (ভাবার্থ–স্ত্রীজাতীর অন্তঃকরণের পাচটি দুরারােগ্য ব্যাধি এই কোন বিষয় শিক্ষার] অযােগ্যতা, অসন্তোষ, পরনিন্দা, হিংসা এবং মূর্খতা। ... নির্ব্বোধ স্ত্রীলােকের কর্তব্য যে প্রত্যেক বিষয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করিয়া স্বামীর আদেশ পালন করে।

তারপর কেহ বলেন “অতিরঞ্জন ও মিথ্যা বচন রমণী-জিহ্বার অলঙ্কার!” আমাদিগকে কেহ “নাকেস-উ-আকেল” এবং কেহ “যুক্তিজ্ঞানহীন” (unreasonable) বলিয়া থাকেন। আমাদের ঐ সকল দোষ আছে বলিয়া তাহারা আমাদিগকে হেয় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দেখুন। এদেশে জামাতা খুব আদরণীয়—এমনকি ডাইনীও জামাই ভালবাসে। তবু “ঘরজামাইয়ের সেরূপ আদর হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখন কাজেই তাহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন।[১] আর আমরা ক্রমশঃ তাহাদের গৃহপালিত পশু পক্ষীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি।


  1. “Although the Japanese wife is considered only the first servant of her husband, she is usually addressed in the house as the honorablc mistress" “acquaintance with European