পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ১৩

সভ্যতা ও সমাজবন্ধনের সৃষ্টি হইলে পর সামাজিক নিয়মগুলি অবশ্য সমাজপতিদের মনােমত হইল! ইহাও স্বাভাবিক। “জোর যার মুলুক তার”। এখন জিজ্ঞাসা করি, আমাদের অবনতির জন্য কে দোষী?

 আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি—এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্যবর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন (originally badges of slavery) ছিল।[১] তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায় লৌহনিশ্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিষ বলিয়া) স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ “মল” পরি। উহাদের হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্শিত চুড়ি! বলা বাহুল্য, লােহার বালাও বাদ দেওয়া হয় না! কুকুরের গলে


    customs has awakened among the more educated classes in Japan a desire to raise the position of women." (Japan) ভাবার্থ —(যদিও জাপানে স্ত্রীকে স্বামীর প্রধান সেবিকা মনে করা হয় কিন্তু সচরাচর তাহাকে গৃহস্থিত অপর সকলে মাননীয়া গৃহিণী বলিয়া ডাকে। যাহা হউক আশা ও সূখের বিষয় এই যে এখন ইউরোপীয় রীতি নীতির সহিত পরিচিত্ত শিক্ষিত সমাজে ক্রমশঃ রমণীর অবস্থা উন্নত করিবার আকাক্ষা জাগ্রত হইতেছে।
    “দার্সী” শব্দে অনেক শ্রীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, “স্বামী” শব্দের অর্থ কি? দানকাকে “দাতা” বলিলে যেমন গ্রহণ কর্তাকে “গ্রহীতা” বলিতেই হয়, সেইরূপ একনকে “স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর” বলিলে অপরকে “দাসী” না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন? যদি বলেন স্ত্রী পতি-প্রেমপাশে আবদ্ধ হওয়ায় তাহার সেবিকা হইয়াছেন, তবে ওরূপ সেবাব্রত গ্রহণে অবশ্য কাহারও আপত্তি হইতে পারে না। কিন্তু পুরুষও কি ঐরূপ পারিবারিক প্রেমে আবদ্ধ হইয়া তাদের প্রতিপালনরূপ সেবাব্রত গ্রহণ করেন নাই? দরিদ্রতম মজুরটিও সমস্ত দিন অনশন পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় দুই এক আনা পয়সা পারিশ্রমিক পাইলে বাজারে গিয়া প্রথমে নিজের উদর-সেবার জন্য দুই পয়সার মুড়ি মুড়কীর শ্রাদ্ধ করে না। বরং তারা চাউল ডাউল কিনিয়া পত্নীকে আনিয়া দেয়। পত্নটি বন্ধনের পর স্বামীকে যে “একমুঠা—আধপেটা অন্নদান করে, পতি বেচারা ৩াহাতেই সন্তুষ্ট হয়। কি চমৎকার আত্মত্যাগ! সমাজ তবু বিবাহিত পুরুষকে “প্রেম-দাস” না বলিয়া স্বামী বলে কেন?
    হ্যাঁ আরও একটা প্রয়ােজনীয় কথা মনে পড়িল; যে সকল দেবী স্ত্রীকে “দাসী” বলায় আপত্তি করেন এবং কথায় কথায় সীত; সাবিত্রীর দোহাই দেন তাহারা কি জানেন না যে, হিন্দুসমাজেই এমন এক বা ততােধিক শ্রেণীর কুলীন আছেন, যাহারা কন্যা ক্রয় করিয়া বিবাহ করেন? যাহাকে অর্থ দ্বারা “ক্রয়” করা হয়, তাহাকে “ক্রীতদাসী” ভিন্ন আর কি বলিতে পারেন? এস্থলে বদিগের পাশবিক্রয়র কথা কেহ উল্লেখ করিতে পারেন বটে, কিন্তু সাধারণে “বর বিক্রয় হয়” এরূপ বলেন না। বিশেষতঃ বরের পাশই বিক্রয় হয়, স্বয়ং বর বিক্রীত হন না। কিন্তু কনা বিক্রয়ের কথায় এ যুক্তি খাটে না; কারণ অষ্টম হইতে দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকার এমন বিশেষ কোন গুণ বা “পাশ” থাকে না, যাহা বিক্রয় হইতে পারে। সুতরাং বালিকা স্বয়ং বিক্রী হয়!! একদা কোন সভ্রান্ত ব্রাহ্মণীর সহিত আলাপ প্রসঙ্গে ঐ কথা উঠায়, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম “কেন ওঁদের সমকক্ষ কুলীন কি পাওয়া যায় না যে মেয়ে কিনতে হয়? তদুত্তরে মহিলাটি বলিয়াছিলেন, “পাওয়া যাবে না কেন? ওদের ঐ কেনা ব্যাটাই নিয়ম। এ যেমন ওর বােন কিনে বিয়ে করলে, আবার এর বোনকে এর একজন কিনে নিয়ে বিয়ে করবে।”
    কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম বা বিশেষ কোন দোষের উল্লেখ করিবার আমাদের আদৌ ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কুতার্কিকদিাগর কুতর্ক নিবারণের নিমিত্ত এইরূপ ক্রীতদাসী ওরফে দেবীর প্রমাণ দিতে বাধ্য হইলাম। এজন্য আমরা নিজেই দুঃখিত। কিন্তু কর্ত্তব্য অবশ্য পালনীয়।

  1. পশ্চিমাঞ্চলের জনৈক শমউ-ওলামা (জাকাট্টা সাহেব বলেন “নখ নাকেল এর (নাকাদীর)ই রূপান্তর!”