পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬ রোকেয়া রচনাবলী

 সুতরাং দেখা যায়, তাঁহাদের অধিক যত্নই আমাদের সর্বনাশের কারণ।

 বিপৎসঙ্কুল সংসার হইতে সর্বদা সুরক্ষিতা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভর ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়া থাকি!! ভ্রাতৃমহোদয়গণ আবার আমাদের “নাকি কান্নার” কথা তুলিয়া কেমন বিদ্রুপ করেন, তাহা কে না জানে? আর সে বিদ্রুপ আমরা নীরবে সহ্য করি। আমরা কেমন শোচনীয়রূপে ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, তাহা ভাবিলে ঘৃণায় লজ্জায় মৃতপ্রায় হই।[১]

 ব্যাঘ্র ভল্লুক ত দূরে থাকুক, আরসুলা জলৌকা প্রভৃতি কীট পতঙ্গ দেখিয়া আমরা ভীতিবিহ্বলা হই! এমনকি অনেকে মূর্ছিত হন! একটি ৯/১০ বৎসরের বালক বোতলে আবদ্ধ একটি জলৌকা লইয়া বাড়ীশুদ্ধ স্ত্রীলোকদের ভীতি উৎপাদন করিয়া আমোদ ভোগ করে। অবলাগণ চীৎকার করিয়া দৌড়িতে থাকেন, আর বালকটি সহাস্যে বোতল হস্তে তাঁহাদের পশ্চাৎ ধাবিত হয়। এমন তামাসা আপনারা দেখেন নাই কি? আমি দেখিয়াছি আর সে কথা ভাবিয়া ঘূণায় লজ্জায় মরমে মরিতেছি। সত্য কথা বলিতে কি, সে সময় বরং


  1. সেদিন (গত ৯ই এপ্রিলের) একখানা উর্দু কাগজে দেখিলাম:— তুরস্কের স্ত্রীলোকেরা সুলতান।সমীপে আবেদন করিয়াছেন যে, “চারি প্রাচীরের ভিতর থাকা ব্যতীত আমাদের আর কোন কাজ নাই। আমাদিগকে অন্ততঃ এ পরিমাণ শিক্ষা দেওয়া হউক, যাহার সাহায্যে যুদ্ধের সময় আমরা আপন আপন বাটী এবং নগর পুরুষদের মত বন্দুক কামান দ্বারা রক্ষা করিতে পারি। তাহারা ঐ আবেদন নিম্নলিখিত উপকারগুলি প্রদর্শন করিয়াছেন:
    (১)  প্রধান উপকার এই যে নগরাদি রক্ষা করিবার জন্য অনেকগুলি সৈন্য নিযুক্ত থাকায় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য সংখ্যা কম হওয়ায় যে ক্ষতি হয়, তাহা আর হইবে না। (যেহেতু “অবলাশ নগর রক্ষা করিবেন!)
    (২) সন্তানসন্ততির শৈশব হইতেই যুদ্ধবিদ্যায় অভ্যস্ত হইব। পিতা মাতা উভয়ে সেপাইী হইলে শিশুগণ ভীরু, কাপুরুষ হইবে না।
    (৩)  তাঁহারা বিশেষ এক নমুনার উদ্দি (Uniform) প্রস্তুত করিবেন, যাহাতে চক্ষু ও নাসিকা ব্যতীত মুখের অবশিষ্ট অংশ এবং সব্বাঙ্গ সম্পূর্ণ আবৃত থাকিবে।
    (৪)  অবরোধপ্রথার সম্মান রক্ষার্থে এই স্থির হইয়াছে যে, অন্ততঃ তিন বৎসর পর্যন্ত প্রত্যেক পরিবারের সৈনিক পুরুষেরা আপন আপন আত্মীয় রমণীদিগকে যুদ্ধ শিক্ষা দিবেন। অতঃপর যুদ্ধশিক্ষাপ্রাপ্ত মহিলাগণ যুদ্ধশিক্ষা দিবার জন্য ঘরে ঘরে দেখা দিবেন। উক্ত মহিলাগণ ইহাও লিখিয়াছেন যে, “আমরা উর্দির (UnifouIT এর খরচের জন্য গবর্ণমেণ্টকে কষ্ট দিব না। কেবল বন্দুক এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সরকার হইতে পাইতে আশা করি।” দেখা যাউক, সুলতান মহোদয় এ দরখাস্তের কি উত্তর দেন। উপরোক্ত সংবাদ সত্য কি না, সেজন্য সেই পত্রিকাখানি দায়ী। কিন্তু ব্রামাদের বিশ্বাস, তুরস্ক রমণীদের ওরূপ আকাক্ষা হওয়া একেবারে অসম্ভব নহে। ইতিহাসে শুনা যায়, পূর্কে তাহারা যুদ্ধ করিনি। একটা যেমন তেমন “মুসলমানী পুঁথিশ্র পাতা উল্টাইলেও আমরা দেখিতে পাই (যুদ্ধ করিতে যাইয়া)

    “জয়ণ নামে বাদশাহজাদী কয়েদ হইল যদি,
    আর যত আরব্য সওয়ার” ইত্যাদি।

     বলি, এদেশের যে সমাজপত্রিগণ “লড়ীকেরাণী হওয়ার প্রস্তাব শুনিলে চমকাইয়া উঠেন (shocked হন)—যাহারা অবলার হস্তে পুতুল সাজান ও ফুলের মালা গাথা ব্যতীত আর কোন শ্রমসাধ্য কার্যের ভার দেওয়ার কল্পনাই করিতে পারেন না, তাহারা ঐ লেডীযোদ্ধা হওয়ার প্রস্তাব শুনিলে কি করিবেন? মূর্ছা যাইবেন না ত?