পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ১৫

বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছুই নহে। যদি অলঙ্কারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্যবর্ধনের উপায় মনে করা যায়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়? সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে? পুরুষেরা ইহ পরাজয়ের নিদর্শন ভাবেন। তাহারা কোন বিষয় তর্ক করিতে গেলে বলেন, “আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুড়ি পরিব”! কবিবর সাদী পুরুষদের উৎসাহিত করিবার জন্য বলিয়াছেন, “আয় মরা বকুশিদ, জাম-এ-জার্না ন পুষিদ”! অর্থাৎ “হে বীরগণ! (জয়ী হইতে) চেষ্টা কর, রমণীর পােষাক পরিও না।” আমাদের পােষাক পরিলে তাহাদের অপমান হয়! দেখা যাউক সে পােষাকটা কি,—কাপড় ত তাহাদের ও আমাদের প্রায় একই প্রকার। একখণ্ড ধুতি ও একখণ্ড সাড়ির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে কিছুমাত্র তারতম্য আছে কি? যে দেশে পুরুষ পাজামা পরে, সে দেশে নারীও পাজামা পরে। Ladies's jacket" শুনা যায়, “Gentlemen's jacket” ও শুনিতে পাই! তবে “জামা-এ-জার্না” বলিলে কাপড় না বুঝাইয়া সম্ভবতঃ শ্রণীসুলভ দুর্বলতা বুঝায়।

 পুরুষজাতি বলেন যে, তাঁহারা আমাদিগকে “বুকের ভিতর বুক পাতিয়া বুক দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছেন, এবং এরূপ সােহাগ আমরা সংসারে পাইব না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সােহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি! ফলতঃ তাহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন, তাহাতেই আমাদের সর্বনাশ হইতেছে। আমাদিগকে তাহারা হৃদয় পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান-সূর্যালােক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিতা রাখিয়াছেন, তাহাতেই আমরা ক্রমশঃ মরিতেছি। তাহারা আরও বলেন, “তাহাদের সুখের সামগ্রী, আমরা মাথায় বহিয়া আনিয়া দিব—আমরা থাকিতে তাহারা দুঃখ সহ্য করিবে কেন?” আমরা ঐ শ্রেণীর বক্তাকে তাহাদের অনুগ্রহপূর্ণ উক্তির জন্য ধন্যবাদ দিই; কিন্তু ভ্রাতঃ! পােড়া সংসারটা কেবল কবির সুখময়ী কল্পনা নহে—ইহা জটিল কুটিল কঠোর সংসার! সত্য বস্তু কবিতা নহে:

“কাব্য উপন্যাস নহে—এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে—ইহা প্রকৃত ভবন”—

 তাই যা কিছু মুস্কিল!! নতুবা আপনাদের কৃপায় আমাদের কোন অভাব হইত না। বঙ্গবালা আপনাদের কম্পিত বর্ণনা অনুসারে “ক্ষীণাঙ্গী, কোমলাঙ্গী, অবলা, ভয়-বিহবলা— ইত্যাদি হইতে হইতে ক্রমে সূক্ষ্ম শরীর (Aerial body) প্রাপ্ত হইয়া বারূপে অনায়াসে আকাশে বিলীন হইতে পারিতেন!! কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তদ্রপ সুখের নহে; তাই এখন মিনতি করিয়া বলিতে চাই:

“অনুগ্রহ করে এই কর, অনুগ্রহ কর না মােদের।”

 বাস্তবিক অত্যধিক যত্নে অনেক বস্তু নষ্ট হয়। যে কাপড় বহু যত্নে বন্ধ করিয়া রাখা যায়, তাহা উইএর ভােগ্য হয়! কবি বেশ বলিয়াছেন।

“কেন নিবে গেল বাতি ?
আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে,
জাগিয় বাসর রাতি,
তাই নিবে গেল বাতি।”