পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮ রোকেয়া রচনাবলী

তাহার চিরসহচর। শরীরে স্ফর্ত্তি না থাকিলে মনেও ফুর্ত্তি থাকে না। সুতরাং ইহাদের মন এবং মস্তিষ্ক উভয়ই চিররোগী। এমন স্বাস্থ্য লইয়া চিররোগী জীবন বহন করা কেমন কষ্টকর তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন।

 ঐ চিত্র দেখিলে কি মনে হয়? আমরা নিজের ও অপরের অবস্থা দেখিয়া শুনিয়া চিন্তা করিলে যে শিক্ষালাভ করি, ইহাই প্রকৃত ধর্ম্মোপদেশ | সময় সময় আমরা পাখী শাখী হইতে যে সদুপদেশ ও জ্ঞানলাভ করি, তাহা পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ একটি আতার পতন দর্শনে মহাত্মা নিউটন যে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন, সে জ্ঞান তৎকালীন কোন পুস্তকে ছিল না। ঐ বধূবেগমের অবস্থা চিন্তা করিতে গিয়া আমি আমাদের সামাজিক অবস্থার এই চিত্র আঁকিতে সক্ষম হইলাম! যাহা হউক, আমি উক্ত বধূবেগমের জন্য বড় দুঃখিত হইলাম, ভাবিলাম, “অভাগীর ইহলোক পরলোক—উভয়ই নষ্ট।” যদি ঈশ্বর হিসাব নিকাশ লয়েন যে, “তোমার মন, মস্তিষ্ক, চক্ষু প্রভৃতির কি সদ্ব্যবহার করিয়াছ?” তাহার উত্তরে বেগম কি বলিবেন? আমি তখন সেই বাড়ীর একটি মেয়েকে বলিলাম, “তুমি যে হস্তপদদ্বারা কোন পরিশ্রম কর না, এজন্য খোদার নিকট কি জবাবদিহি (explanation) দিবে?” সে বলিল, “আব্বা কহনা ঠিক হ্যায়”—এবং সে যে সময় নষ্ট করে না, সতত চলাফেরা করে, আমাকে ইহাও জানাইল। আমি পুনরায় বলিলাম, “শুধু ঘুরা ফেরা করিলেই ব্যায়াম হয় না। তুমি প্রতিদিন অন্ততঃ আধঘণ্টা দৌড়াদৌড়ি করিও।” দৌড়াদৌড়ি কথাটার উত্তরে হাসির একটা গররা উঠিল। আমি কিন্তু ব্যথিত হইলাম, ভাবিলাম, “উল্টা বুঝলি রাম!” কোন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিবার শক্তিটুকুও ইহাদের নাই। আমাদের উন্নতির আশা বহুদূরে—ভরসা কেবল পতিতপাবন।

 আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ একপ্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারেন কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরূপ সুধাভাণ্ডারের দ্বার কখনও সম্পূর্ণ রূপে উমুক্ত হইবে কি? যদি কোন উদারচেতা মহাত্মা দয়া করিয়া আমাদের হাত ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হন, তাহা হইলে সহস্র জনে বাধা বিঘ্ন উপস্থিত করেন।

 সহস্র জনের বাধা ঠেলিয়া অগ্রসর হওয়া একজনের কার্য্য নহে। তাই একটু আশার আলোক দীপ্তি পাইতে না পাইতে চির নিরাশার অন্ধকারে বিলীন হয়। স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটা কুসংস্কার আছে যে তাহারা “স্ত্রীশিক্ষা” শব্দ শুনিলেই “শিক্ষার কুফলের” একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া উঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লানবদনে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্তা মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোন কম্পিত দোষ শতগুণ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ “শিক্ষার” ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কষ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে “স্ত্রীশিক্ষাকে নমস্কার”!

 আজি কালি অধিকাংশ লোকে শিক্ষাকে কেবল চাকরী লাভের পৃথ মনে করে। মহিলাগণের চাকরী গ্রহণ অসম্ভব সুতরাং এই সকল লোকের চক্ষে স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।

 ফাকা তর্কের অনুরোধে আবার কোন নেটীভ খ্রীষ্টিয়ান হয়ত মনে করিবেন যে রমণীর জ্ঞান-পিপাসাই মানবজাতির অধঃপাতের কারণ যেহেতু শাস্ত্রে (Genesis-এ) দেখা যায়,