পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর : প্রথম খণ্ড ১৯

আদিমাতা হাভা (Eve) জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ করিয়াছিলেন বলিয়া তিনি এবং আদম উভয়েই স্বর্গচ্যুত হইয়াছেন![১]

 যাহা হউক “শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের “অন্ধ-অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (ievelop) করাই শিক্ষা।স ঐগুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত পদ, চক্ষু, কর্ণ, মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত, দ্বারা সৎকার্য্য করি, চক্ষুদ্বারা মনােযােগ সহকারে দর্শন (বা observe) করি, কর্ণ দ্বারা মনােযােগ পূর্ব্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি—তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল “পাশ করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না। দর্শনশক্তির বৃদ্ধি বা বিকাশ সম্বন্ধে একটা উদাহরণ দিতেছি:

 যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু ধূলি, কর্ম ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পায় না, সেখানে (বিজ্ঞানের শিক্ষিত চক্ষু অনেক মনােরম চমৎকার বস্তু দেখিতে পায়। আমাদের পদদলিত যে কাদাকে আমরা কেবল মাটি, বালি, কয়লার কালি ও জলমিশ্রিত পদার্থ বলিয়া তুচ্ছ জ্ঞান করি, বিজ্ঞানবিদ তাহা বিশ্লিষ্ট করিলে নিম্নলিখিত বস্তু চতুষ্টয় প্রাপ্ত হইবেন। যথা-বালুকা বিশ্লেষণ করিলে সাদা পাথর বিশেষ (opal); কর্দম পৃথক করিলে চিনে বসন প্রস্তুত করণােপযােগী মৃত্তিকা, অথবা নীলকান্তমণি; পাথরু-কয়লার কালি দ্বারা হীরক! এবং জল দ্বারা একবিন্দু নীহার! দেখিলেন, ভগিনী! যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা মাণিক দেখে! আমরা যে এহেন চক্ষুকে চির-অন্ধ করিয়া রাখি, এজন্য খােদার নিকট কি উত্তর দিব?

 মনে করুন আপনার দাসীকে আপনি একটা সম্মানী দিয়া বলিলেন, “যা, আমার অমুক বাড়ী পরিষ্কার রাখি।” দাসী সম্মাজ্জনীটা আপনার দান মনে করিয়া অতি যত্নে জরির ওয়াড়ে ঢাকিয়া উচ্চস্থানে তুলিয়া রাখিল-কোন কালে ব্যবহার করিল না। এদিকে আপনার বাড়ী ক্রমে আবর্জনাপূর্ণ হইয়া বাসের অযােগ্য হইল! অতঃপর আপনি যখন দাসীর কার্য্যের হিসাব লইবেন, তখন বাড়ীর দুরবস্থা দেখিয়া আপনার মনে কি হইবে? শতমুখী ব্যবহার করিয়া বাড়ী পরিষ্কার রাখিলে আপনি খুসী হইবেন, না তাহার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করিলে সন্তুষ্ট হইবেন?

 বিবেক আমাদিগকে আমাদের প্রকৃত অবনতি দেখাইয়া দিতেছে-এখন উন্নতির চেষ্টা কর্য আমাদের কর্তব্য।

 আমাদের উচিত যে স্বহস্তে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করি। এক স্থলে আমি বলিয়াছি “ভরসা কেবল পতিতপাবন” কিন্তু ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে, উর্ধ্বে হস্তু উত্তোলন না করিলে পতিতপাবনও হাত ধরিয়া তুলিবেন না। ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করেন যে নিজে নিজের


  1. পরন্তু ইউরােপীয় খৃষ্টানদের বিশ্বাস যে Eye অভিশপ্ত হইয়াছিলেন, সত্য; কিন্তু যীশুখৃষ্ট আসিয়া নারীজাতিকে সে অভিশাপ হইতে মুক্তি দিয়াছেন। তাহারা বলেন “Through woman came curse and sin: and through women came blessing and salvation also." (ভাবার্থ নারীর দোষে জগতে অভিশাপ ও পাপ আসিয়াছে এবং নারীর কল্যাণেই আশীৰ্বাদ এবং মুক্তিও আসিয়াছে)। পুরুষ খ্রীষ্টের পিতা হয় নাই, কিন্তু রমণী যীশুখ্রীষ্টের মাতৃপদ প্রাপ্তে গৌরবান্বিতা হইয়াছেন।