পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর : প্রথম খণ্ড ২৫

 আমরা সকলেই কবি—আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশী। আমাদের এখানে লেখক অপেক্ষা লেখিকার সংখ্যা বেশী। তাই কবিতার স্রোতে বিনা কারণে অশুপ্রবাহ বেশী বহিয়া থাকে। আমরা পদ্য লিখিতে বসিলে কোন বিষয়টা বাদ দিই? “ভগ্ন শুপ”, “জীর্ণ কথা”, “পুরাতন চটীজুতা”— কিছুই পরিত্যজ্য নহে। আমরা আবার কত নূতন শব্দের সৃষ্টি করিয়াছি; যথা—“অতি শুভ্রনীলাম্বর”, “সাশ্রুসজলনয়ন” ইত্যাদি। শীমতীদের করুণ বিলাপ-প্রলাপপূর্ণ পদ্যের “অশ্রুজলের বন্যায় বঙ্গদেশ ধীরে ধীরে ডুবিয়া যাইতেছে! সুতরাং দেখিতেছেন, আমরা সকলেই কবি।

 আর আত্মপ্রশংসা কত করিব? এখন উপসংহার করি।[১]

অদ্ধাঙ্গী

কোন রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক। তাই অবলাজাতির উন্নতির পথ আবিষ্কার করিবার পূর্বে তাহাদের অবনতির চিত্র দেখাইতে হয়। আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” শীর্ষক প্রবন্ধে ভগিনিদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে—দাসত্ব। সে রোগের কারণ এবং অবস্থা কতক পরিমাণে ইতঃপূর্ব্বে বর্ণনা করা হইয়াছে। এক্ষণে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব, সেই রোগ হওয়ায় আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন বিকৃত হইয়াছে। ঔষধ পথ্যের বিধান স্থানান্তরে দেওয়া হইবে।

 এইখানে গোড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের অবগতির জন্য দু একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহগরে পাঠ করেন নাই।

 সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের আলোচনা করিয়াছি।

 কোন একটা নুতন কাজ করিতে গেলে সমাজ প্রথমতঃ গোলযোগ উপস্থিত করে এবং পারে সেই নূতন চালচলন সহিয়া লয়, তাহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ পাসী মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থার উল্লেখ করিয়াছি। পূর্বে তাহারা ছত্রব্যবহারেরও অধিকারিণী ছিলেন না, তারপর তাহাদের বাড়াবাড়িটা সীমা লঘন করিয়াছে, তবু ত পৃথিবী ধ্বংস হয় নাই। এখন পাসী মহিলাদের পর্দামোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অবশ্যই হয় নাই। আর ঐ যে পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহা দ্বারা তাঁহাদের স্বকীয় বুদ্ধিবিবেচনার ত কোন


  1. গত ১৩১০ সালে “নিরীহ বাঙ্গালী” লিখিত হইয়াছে। সুখের বিষয় বর্তমান সালে আর বাঙ্গালী“পুরুষিকা” নহেন। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে এমন শুভ পরিবর্তন হইবে, ইহা কে জানিত? জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ, এখন আমরা সাহসী বাঙ্গালী।