পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪ রোকেয়া রচনাবলী

বাগান হইবে, কোন স্থানে রন্ধনশালা হইবে ইত্যাদি তাহারই পসন্দ অনুসারে হওয়া চাই ভাড়াটে বাড়ী হইলে তাহার কোন্ কামরা কিরূপে ব্যবহৃত হইবে, সে বিষয়ে সলিকা চাই। যেহেতু তিনি গৃহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কিন্তু বলি, কয় জন গৃহিণীর এ জ্ঞান আছে? আমরা এমন গৃহিণী যে গৃহব্যাপারই বুঝি না! আমাদের বিষমেল্লায়ই গলৎ!!

 গৃহনির্মাণের পর গৃহসামগ্রী চাই। তাহা সাজাইয়া গুছাইয়া রাখার জন্যও সলিকা চাই। কোথায় কোন জিনিষটা থাকিলে মানায় ভাল, কোথায় কি মানায় না, এ সব বুঝিবার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। একটা মেয়েলী প্রবাদ আছে, “সেই ধান সেই চাউল গিন্নী গুণে আউল ঝাউল” (এলােমেলাে)। ভঁড়ার ঘরে সচরাচর দেখা যায়, মাকড়সার জাল দোয়ারূপে শােভা পাইতেছে! তেঁতুলে তণ্ডুলে বেশ মেশামিশী হইয়া আছে, কোথাও ধ’নের সহিত মৌরী মিশিয়াছে। চিনি খুঁজিয়া বাহির করিতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। চারি দিক বন্ধ থাকে বলিয়া ভঁড়ার ঘরের দ্বার খােলা মাত্র বদ্ধ বায়ুর এক প্রকার দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। অভ্যাসের কৃপায় এ দুর্গন্ধ গিন্নিদের অপ্রিয় বােধ হয় না।

 অনেক শ্রীমতী পানসাজিতে বসিয়া যাতির খােজ করেন; যাতি পাওয়া গেলে দেখেন পানগুলি ধােওয়া হয় নাই। পানের ডিবে কোন ছেলে কোথায় রাখে তার ঠিক নাই! কখন বা খয়ের ও চূণের সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত পদার্থ প্রস্তুত হইয়া থাকে। পান থাকে ঘটিতে, সুপারী থাকে একটা সাজিতে, খয়ের হয়ত থাকে কাপড়ের বাক্সে! অবশ্য “সাহেবে সলিকা” গণ এরূপ করেন না। তাহাদের পানের সমস্ত জিনিষ যথাস্থানে সুসজ্জিত থাকে।

 কেহ বা চার পাত্র (tea-pot) মৎস্যাধাররূপে ব্যবহার করেন, ময়দা চালিবার চালনীতে পটল, কুমড়া প্রভৃতি তরকারি কুটিয়া রাখা হয়। পিতলের বাটীতে তেঁতুলের আচার থাকে। পূর্ব্বে মুসলমানেরা “মােকাবা” (পাত্র বিশেষ, যাহাতে চুল বাঁধিবার সরঞ্জাম থাকে) রাখিতেন, আজি কালি অনেকে toilettable রাখেন। ইহাদের “মােকাবায়” কিংবা টেবিলের উপর চিরুণী তৈল (toilet সামগ্রী ছাড়া আরও অনেক জিনিষ থাকে, যাহার সহিত কেশবিন্যাস সামগ্রীর (toilet-এর কোন সম্পর্ক নাই।

 পরিমিত ব্যয় করা গৃহিণীর একটা প্রধান গুণ। হতভাগা পুরুষেরা টাকা উপার্জন করিতে কিরূপ শ্রম ও যত্ন করেন, কতখানি মাথার ঘাম পায় ফেলিয়া এক একটী পয়সার মূল্য (পারিশ্রমিক) দিয়া থাকেন, অনেক গৃহিণী তাহা একটু চিন্তা করিয়াও দেখেন না। উপার্জন না করিলে স্বামীর সহিত ঝগড়া করিবেন, যথাসাধ্য কটুকাটব্য বলিবেন, কিন্তু একটু সহানুভূতি করেন কই? ঐ মার্জিত টাকাগুলি কন্যার বিবাহে বা পুত্রের অন্নপ্রাশনে কেবল সাধ (আমােদ আহ্লাদে ব্যয় করিবেন, অথবা অলঙ্কার গড়াইতে ঐ টাকা দ্বারা স্বর্ণকারের উদরপূর্ত্তি করিবেন। স্বামী বেচারা এক সময় চাকরীর আশায় সার্টিফিকেট কুড়াইবার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া, বহু আয়াসে সামান্য বেতনের চাকরী প্রাপ্ত হইয়া প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া যে টাকা কয়টি পত্নীর হাতে আনিয়া দেন, তাহার অধিকাংশ মল ও নুপুরের


    (মাশুল) ইত্যাদি শব্দ বহুকাল হইতে বাঙ্গালায় প্রচলিত আছে।“সলিকা”ও চলুক। “সাহেরে সলিকা অর্থে যাহার সলিকা আছে (person of taste) বুঝায়।