পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ৩৭

সেলাইয়ের সহিত মেশিনএর সেলাইয়ের তুলনা করিয়া দেখিবেন ত কোটি শ্রেষ্ঠ? তাহা ছাড়া মেশিন দ্বারা অল্প সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমে অধিক সেলাই হয়। অতএব মেশিন চালনা শিক্ষা করাই শ্রেয়ঃ। এতদ্ব্যতীত ক্যানভাস (Canvas) এর জুতা, পশমের মােজা, শাল প্রভৃতি কে না ব্যবহার করিতে চাহেন? এই প্রকারের সূচিকার্য্য ইংরাজী। (knitting Crochet সম্বন্ধীয়) ব্যবস্থাপত্রের সাহায্য ব্যতীত সুচারুরূপে হয় না। ঐ ব্যবস্থাপুস্তকপাঠে শিক্ষয়িত্রীর বিনা সাহায্যে সূচিকর্মে সুনিপুণা হওয়া যায়; কাপড়ের উঁট কাট সবই উৎকৃষ্ট হয়। কাপড়ের কাট ছাঁটের জন্যও ত বুদ্ধির দরকার। কাপড়, পশম, জুতা ইত্যাদির পরিমাণ জানা থাকিলে, একজোড়া মােজার জন্য তিন জোড়ার পশম কিনিয়া অনর্থক অপব্যয় করিতেও হয় না।

 পরিবারভুক্ত লােকদের সেবা যত্ন করা গৃহিণীর অবশ্য কর্তব্য। প্রত্যেকের সুখ সুবিধার নিমিত্ত নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ করা রমণীজীবনের ধর্ম্ম। এ কার্যের জন্যও সুশিক্ষা (training) চাই। সচরাচর গৃহিণীরা পরিজনকে সুখ দিবেন ত দূরের কথা, তাঁহাদের সহিত ছোট ছােট বিষয় লইয়া কেঁদল কলহে সময় কাটাইয়া থাকেন। শাশুড়ীর নিন্দা ননদিনীর নিকট, আবার ননদের কুৎসা মাতার নিকট করেন, এইভাবে দিন যায়।

 কেহ পীড়িত হইলে তাহার যথােচিত সেবা করা গৃহিণীর কর্ত্তব্য, রােগীর সেবা অতি গুরুতর কার্য। যথারীতি শুশ্রুষা-প্রণালী {nursing) অবগত না হইলে এ বিষয়ে কৃতকার্য হওয়া যায় না। আমাদের দেশে অধিকাংশ রােগী ঔষ পথ্যের অভাব না হইলেও শুশ্রষার অভাবে মারা যায়। অনেক স্থানে নিরক্ষর সেবিকা রােগীকে মালিশের ঔষধ খাওয়াইয়া দেয়। কেহ বা অসাবধানতাবশতঃ বিষাক্ত ঔষধ যেখানে সেখানে রাখে, তাহাতে অবােধ শিশুরা সেই ঔষধ খাইয়া ফেলে। এইরূপ ভ্রমের জন্য চিরজীবন অনুতাপে দগ্ধ হইতে হয়। কে বা রােগীর নিদ্রা ভঙ্গ করিয়া পথ্য দান করে, কেহ অত্যধিক স্নেহবশতঃ তিন চারি বারের ঔষধ একবারে সেবন করায়। এরূপ ঘটনা এদেশে বিরল নহে। ডাক্তারী বিষয়ে সেবিকার উপযুক্ত জ্ঞান থাকা আবশ্যক, একথা কেই অস্বীকার করেন কি? ডাক্তারী না জানিয়া শুশ্রুষা করিতে যাওয়া যা, আর স্বর্ণকারের কাজ শিখিয়া চৰ্মকারের কাজ করিতে যাওয়াও তাই।

 কিন্তু ডাক্তারী জান বা না জান, রােগীর সেবা সকলকেই করিতে হয়, এমন দুহিতা কে আছেন, যিনি অশ্রুধারায় জননীর পদ প্রক্ষালন করিতে করিতে ভাবেন না যে “এত যত্ন পরিশ্রম সব ব্যর্থ হ’ল; আমার নিজের পরমায়ুঃ দিয়াও যদি মাকে বাঁচাইতে পারিতাম।” এমন ভগিনী কে আছেন, যিনি পীড়িত ভ্রাতার পার্শ্বে বসিয়া অনাহারে দিন যাপন করেন না? এমন যিনি স্বামীর পীড়ার জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া নিজে আধমরা হন না? এমন জনী কে আছেন, যিনি জীবনে কখনও পীড়িত শিশু কোলে লইয়া অনিদ্রায় রজনী যাপন করেন নাই? যিনি কখনও এরূপ রােগীর সেবা করেন নাই, তিনি প্রেম শিখেন নাই। না দিলে প্রেম শিক্ষা হয় না।

 বিপদের সময় প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব রক্ষা করা অতি আবশ্যক। এই গুণটা আমাদের অনেকেরই নাই। আমরা কেবল হায়! হায়! করিয়া কাঁদিতে জানি! বােধ হয় আশ থাকে যে, অবলার চক্ষের জল দেখিয়া শমনদেব সদয় হইবেন। অনেক সময় দেখা যায় বাগী এ