পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০ রোকেয়া রচনাবলী

বা আর কিছু। সুগৃহিণী এই সত্য আপন পরিবার মধ্যে প্রচার করিবেন। তাহার ফলে তাহার পরিবার হইতে ক্ষুদ্র স্বার্থ, হিংসা দ্বেষ ইত্যাদি ক্রমে তিরােহিত হইবে এবং তাহার গৃহ দেবভবন সদৃশ ও পরিঞ্জন দেবতুল্য হইবে। এমন ভারতমহিলা কে, যিনি আপন ভবনকে আদর্শ দেবালয় করিতে না চাহিবেন?

 দরিদ্রা প্রতিবেশিনীদিগকে নানা প্রকারে সাহায্য করাও আমাদের অন্যতম কত্তব্য। তাহাদের সূচিশিল্প এবং চরকায় প্রস্তুত সুত্রের বস্ত্রাদি উচিত মূল্যে ক্রয় করিলে তাহাদের পরম উপকার করা হয়। এইরূপে এবং আরও অনেক প্রকারে তাহাদের সাহায্য করা যাইতে পারে; বিস্তারিত বলা বাহুল্য মাত্র।

 আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, বালক বালিকাদিগকে ভূত্যের প্রতি সদয় ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। সচরাচর দেখা যায়, বড় ঘরের বালকেরা ভারী দাম্ভিক হয়, তাহারা চাকরকে নিতান্ত নগণ্য কি যেন কি মনে করে। বেতনভােগী হইলেই ভৃত্যবর্গ যে মানুষ এবং তাহাদেরও স্বীয় পদানুসারে মান অপমান জ্ঞান আছে, সুকুমারমতি শিশুদিগকে একথা বুঝাইয়া দেওয়া উচিত। অনেক গৃহিণী নিজের পুত্রকন্যার দোষ বুঝেন না, তাহারা চাকরকেই অযথা শাসন করেন। ওরূপে শিশুকে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়।

 উর্দু “বানাতননাশ” গ্রন্থে বর্ণিত নবাবনন্দিনী হােসনে-আরা অন্যায় আদরে এমন দুর্দান্ত হইয়া উঠিয়াছিল যে তাহার দৌরাত্মে দাসী, পাচিকা প্রভৃতি সেবিকাবৃন্দ ত্রাহি ত্রাহি করিত।[১] যাহাতে বালিকারা বিনয়ী এবং শিষ্ট শান্ত হয়, এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি রাখা কর্তব্য।


  1. হােসেন-আরার বাল-সুলভ ঔদ্ধত্যের বর্ণনা বেশ আমােদপ্রদ| পাঠিকাদিগকে একটু নমুনা উপহার দিই: হােসেন-আরার, পিতা মাতা জোষ্ঠ ভ্রাতা ভগিনী—কাহাকেই ভয় করি না। সমস্ত বাড়ি সে মাথায় তুলিয়া রাখিত। একদিন তাহার বড় মাসী শাহজামানী বেগম তাহাদিগকে দেখিতে আসিয়াছেন। পরিচারিকার দল হয় ও ভাবিল, ছােট বেগমের হোসেন-আরার মাত্রার নিকট অভিযােগে বিশেষ কোন ফল হয় না; বড় বেম নবাগতা, ইহাকে দেখিয়া হােসেন-আরার চপলতা কিঞ্চিৎ দক্ষিয়া যাইবে। শাহজামানী বেগম শিবিকা হইতে অবতরণ করিবা মাত্র ক্রমান্বয়ে দুই চারি অভিযােগ উপস্থিত হইল। নরগেস কাদিয়া আসিয়া বলিল, “দেখুন, ছােট সাহেবজাদী (হােসেন-আরা) এমন পাথর ছুড়িয়া মরিয়াছেন ভাগ্যক্রমে আমার চক্ষু নষ্ট হয় নাই।” সেসন আসিয়া বলিল, “দেখুন, ছােট সাহেবজাদী আমায় বলিলেন, ‘দেখি সােসন তাের জিহ্বা,' যেই আমি জিবা বাহির করিলাম অমনি তিনি আমার চিবুকে এমন জোরে মুষ্ট্যাঘাত করিলেন যে আমার সমস্ত দাঁত রসনায় বিদ্ধ হইয়াছিল।” গােলাপ চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল,“হায়! আমার কাণ রক্তাক্ত করিয়া দিলেন?” রন্ধনশালা হইতে পাছিকা উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “এই দেখুন ছােট সাহেবজাদী তরকারির হাঁড়িতে মুঠা বিয়া ছাই দিতেছেন?” ঐ সব শুনিয়া বড় বেগম ডাকিলেন, “হােসনা। এখানে আইস!” হােসনা তৎক্ষণাৎ আসিল ত; কিন্তু আসিয়া, মাসীকে নমস্কার করিবে ত দূরের কথা, হাতে ছাই পায় কাদা—এই অবস্থায় সে হঠাৎ মাসীর গলা জড়াইয়া ধরিল। তিনি সাদরে বলিলেন, “হােসনা! তুমি বড় দুষ্ট হইয়াছ। হােসনা তখন উপস্থিত দার্সীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “এই সম্বেল পেত্নী বুঝি কোন কথা আপনাকে লাগাইয়াছে?” এই বলিয়াই সে মাসীর ক্রোড় হইতে লাফাইয়া উঠিয়া নির্দোষ সম্বেলের কেশাকর্ষণ করিয়া প্রহার আরম্ভ করিল! “আঁ! এ কি কর? কি কর?” বলিয়া বড় বেগম বারম্বার নিষেধ করিলেন, কিন্তু সে কিছুই শুনিল না।