পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর :প্রথম খণ্ড ৪১

 পরিশেষে বলি প্রেমিক হও, ধার্ম্মিৰ্ক হও বা নাস্তিক হও, যাই হইতে চাও, তাহাতেই মানসিক উন্নতির (mental culture-এর প্রয়ােজন। প্রেমিক হইতে গেলে নির্ভর ন্যায়পরতা, মাশুকের[১]নিমিত্ত আত্মবিসর্জন ইত্যাদি শিক্ষণীয়। নতুবা নির্বোধ বন্ধু হইলে কাহারই উপকার করিতে পারিবে না। ধর্ম্মসাধনের নিমিত্ত শিক্ষা দীক্ষার প্রয়ােজন, কারণ “কে বে-ইলাম না তা খােদারা শেনাখত”। অর্থাৎ জ্ঞান না হইলে ঈশ্বরকে চেনা যায় না। অত্র প্রবাদ আছে “মূখের উপাসনা ও বিদ্বানের শয়নাবস্থা সমান”। অতএব দেখা যায় যে, এমণীর জন্য আজ পর্যন্ত যে সব কর্ত্তব্য নির্ধারিত আছে, তাহা সাধন করিতেও বুদ্ধির প্রয়োজন। অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত পুরুষদের যেমন মানসিক শিক্ষা (mental culture) আবশ্যক, গৃহস্থালীর জন্য গৃহিণীদেরও তদ্রুপ মানসিক শিক্ষা (mental culture) প্রয়ােজনীয়।

 ইতর শ্রেণীর লােকদের মত যেমন-তেমন ভাবে গৃহস্থালী করিলেও সংসার চলে বটে, কিন্তু সেরূপ গৃহিণীকে সুগৃহিণী বলা যায় না; এবং ঐ সব ডােম চামারের পুত্রগণ যে কালে বিদ্যাসাগর” “বিদ্যাভূষণ” বা“তর্কালঙ্কার” হইবে এরূপ আশাও বােধ হয় কেহ করেন না।

 আমি আমার বক্তব্য শেষ করিলাম। এখন সাধনাদ্বারা সিদ্ধিলাভ করা আপনাদের শত্তব্য। যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলােকের জন্য সশিক্ষার আয়ােজন করিবেন।


বােরকা

আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে আমাদের “জঘন্য অবরােধ প্রথা”ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাহারা প্রায়ই আমাকে “বােরকা” ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিষটা কি? তাহ কি কেবল বােরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে কি বুঝিব যে জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলােকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?

 আমাদের ত বিশ্বাস যে অবরােধের সহিত উন্নতির বেশী বিরােধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। কেহ কেহ বলেন যে ঐ উচ্চশিক্ষা লাভ করিতে হইলে এফ,এ, বি,এ, পরীক্ষার জন্য পর্দা কাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (University Hall-এ) উপস্থিত হইতে হইবে | এ যুক্তি মন্দ নহে! কেন? আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় (University) হওয়া এবং পরীক্ষক স্ত্রীলােক হওয়া কি অসম্ভব? যতদিন এইরূপ বন্দোবস্ত হয়, ততদিন আমাদের পাশকরা বিদ্যা না হইলেও চলিবে।

 অবরােধ প্রথা স্বাভাবিক নহে—নৈতিক। কেননা পশুদের মধ্যে এ নিয়ম নাই। মনুষ্য মে সভ্য হইয়া অনেক অস্বাভাবিক কাজ করিতে শিখিয়াছে। যথা—পদব্রজে ভ্রমণ করা


    পরে হােসেন-ত্রার জেনানা মক্তবে (পাঠশালায়) প্রেরিত হইয়া সুশিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছিল। এতদ্বারা। লেখক মহােদয় দেখাইয়াছেন যে অমন অবাধ্য অনমা বালিকাও শিক্ষার গুণে ভাল হয়। আমাদের বিশ্বাস সুশিক্ষা স্পর্শমণি যাহাকে স্পর্শ করে সেই সুবর্ণ হয়।

  1. “মাশুক”—যাহাকে ভালবাসা যায়; beloved object