পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর:প্রথম খণ্ড ৪৩

 নিমন্ত্রণ ইত্যাদি রক্ষা করিতে যাইলে মহিলাগণ সচরাচর উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ ও বহুমূল্য অলঙ্কার ব্যবহার করিয়া থাকেন। গাড়ী হইতে নামিবার সময় ঐ পরিচ্ছদ রূপ আভরণ কোচম্যান দ্বারবান প্রভৃতির দৃষ্টি হইতে গােপন করিবার জন্য একটা সাদাসিধা (simple) বােরকার আবশ্যক হয়। রেলওয়ে ভ্রমণ কালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘােমটা কিম্বা বােরকার দরকার হয়।

 সময় সময় ইউরােপীয় ভগ্নীগণও বলিয়া থাকেন, “আপনি কেন পর্দা ছাড়েন না (Why don't you break off purdah)?” কি জ্বালা! মানুষে নাকি পর্দা ছাড়িতে পারে? ইহাদের মতে পর্দা অর্থে কেবল অন্তঃপুরে থাকা বুঝায়। নচেৎ তাহারা যদি বুঝিতেন যে তাহারা নিজেও পর্দার (অর্থাৎ privacyর) হাত এড়াইতে পারেন না, তবে ওরূপ বলিতেন না। যদিও তাঁহাদের পােষাকেও সম্পূর্ণ পর্দা রক্ষা হয় না, বিশেষতঃ সান্ধ্য-পরিধেয় (evening dress) ত নিতান্তই আপত্তিজনক। তবু তাহা বহু কামিনীর একহারা মিহি সাড়ী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

 তারপর অন্তঃপুর ত্যাগের কথা—অন্তঃপুর ছাড়িলে যে কি উন্নতি হয়, তাহা আমরা ত বুঝি না। প্রকারান্তরে উক্ত স্বাধীনা রমণীদেরও ত শয়নকক্ষরূপ অন্তঃপুর আছে।

 মােটের উপর আমরা দেখিতে পাই সকল সভ্যজাতিদেরই কোন না কোন রূপ অবরােধ প্রথা আছে। এই অবরােধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? এমন পবিত্র অবরােধ-প্রথাকে যিনি “জঘন্য” বলেন, তাঁহার কথার ভাব আমরা বুঝিতে অক্ষম।

 সভ্যতা (civilization)-ই জগতে পদা বৃদ্ধি করিতেছে। যেমন পূর্বে লােকে চিঠিপত্র কেবল ভাঁজ করিয়া পাঠাইত, এখন সভ্য (civilized) লােকে চিঠির উপর লেফাফার আবরণ দেন। চাষারা ভাতের থালা ঢাকে না; অপেক্ষাকৃত সভ্য লােকে খাদ্য সামগ্রীর তিন চারি পাত্র একখানা বড় থালায় (tray-তে রাখিয়া উপরে একটা “খানপােষ” বা “সরপােষ” 15াকা দেন; যাহারা আরও বেশী সভ্য তাহাদের খাদ্য বস্তুর প্রত্যেক পাত্রের স্বতন্ত্র আবরণ থাকে। এইরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে, যেমন টেবিলের আবরণ, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়-ইত্যাদি।

 আজিকালি যে সকল ভগ্নী নগ্নপদে বেড়াইয়া থাকেন, তাহাদেরই আত্মীয়া সুশিক্ষিত {enligthtened) ভগ্নীগণ আবার সভ্যতার পরিচায়ক মােজা জুতার ভিতর পদযুগল আবৃত করেন। ক্রমে হাত ঢাকিবার জন্য দস্তানার সৃষ্টি হইয়াছে। তবেই দেখা যায়—সভ্যতার (civilization-এর) সহিত অবরােধ প্রথার বিরােধ নাই।

 তবে সকল নিয়মেরই একটা সীমা আছে। এদেশে আমাদের অবরােধ-প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। যেমন অবিবাহিতা বালিকাগণ স্ত্রীলােকের সহিতও পর্দা করিতে বাধ্য থাকেন! কখন কোন প্রতিবেশিনী আসিয়া উপস্থিত হইবে, এই ভয়ে নবম বর্ষীয়া বালিকা প্রাঙ্গণে বাহির হয় না। এই ভাবে সর্বদা গৃহকোণে বন্দিনী থাকায় তাহাদের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয়। দ্বিতীয়তঃ তাহাদের সুশিক্ষার ব্যাঘাত হয়। যেহেতু খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কীয়া আত্মীয়া ব্যতীত তাহারা অন্য কাহাকেও দেখতে পায় না, তবে শিখিবে কাহার নিকট? নববধূদের


    নয়নে ইতস্ততঃ না দেখে!) এবং তাহারা যেন আভরণ (বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ব্যতীত) অর্য লােককে না দেখায়।”