পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৪ রোকেয়া রচনাবলী

অন্যায় পর্দাও উল্লেখযোগ্য। তাহারা বিবাহের পর প্রথম দুই চারি মাস কেবল “জড় পুত্তলিকা” সাজিয়া থাকিতে বাধ্য হন। ঐরূপ কৃত্রিম অন্ধ ও বোকা হইয়া থাকায় কেমন অসুবিধা ভোগ করিতে হয়, তাহা যে সশরীরে ভোগ করে, সেই জানে!! কথিত আছে, কোন সময় একটি সভ্রান্ত পরিবারের নববধূর পৃষ্ঠে ঘটনাক্রমে বৃশ্চিক দংশন করে—তিনি সে যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করিয়াছিলেন। তৃতীয় দিবস “চৌথীর স্নানের সময় অন্য স্ত্রীলোকেরা তাহার পৃষ্ঠের ক্ষত দেখিয়া দুঃখিত হইয়াছিল! আজি কালি বৃদ্ধাগণ খুব প্রশংসার সহিত ঐ বধূটির উপমা দিয়া থাকেন! বোধ হয় বৃশ্চিকটা খুব বিষাক্ত ছিল না!

 যাহা হউক ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম (moderate) করিতে হইবে। অনেক পরিবারে মহিলাগণ ঘনিষ্ট কুটুম্ব ব্যতীত অপর কাহারও বাটী যাতায়াত করেন না। ইহাতে পাচ রকমের স্ত্রীলোকের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইতে পারে না বলিয়া তাঁহারা একেবারে কুপমণ্ডুক হইয়া থাকেন। অন্তঃপুরিকাদের পরস্পর দেখা শুনা বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরুষেরা যেমন সকল শ্রেণীর লোকের সহিত আলাপ করিয়া থাকেন, আমাদেরও অজ্রপ করা উচিত। অবশ্য আঁহাদিগকে আমরা ভদ্র-শিষ্ট বলিয়া জানি, কেবল তহ্যদের সঙ্গে মিশির,—তাঁহারা যে কোন ধর্মাবলম্বিনী (য়িহুদী, নাসারা, বুৎপুরস্ত বা যাই হউন, ক্ষতি নাই। এই যে “গয়ের মজহব” বিশিষ্ট স্ত্রীলোকের সহিত পর্দা করা হয়, ইহা ছাড়িতে হইবে। আমাদের ধর্ম ত ভঙ্গপ্রবণ নহে, তবে অন্য ধর্মাবলম্বিনী স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা হইলে ধর্ম্ম নষ্ট হইবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ কি?

 আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয়। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস (practice) চাই; বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয়?

 সচরাচর বোরকার আকৃতি অত্যন্ত মোটা (course) হইয়া থাকে। ইহাকে কিছু সুদর্শন (fine) করিতে হইবে। জুতা কাপড় প্রভৃতি যেমন ক্রমশঃ উন্নতি প্রাপ্ত হইয়াছে, সেইরূপ বোরকারও উন্নতি প্রার্থনীয়। যে বেচারা বোরকা সুদূর আরব হইতে এদেশে আসিয়াছে, তাহাকে হঠাৎ নির্বাসিত করিলেই কি আমরা উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠিব?

 সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই—শিক্ষার অভাবে হইয়াছে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে। ললনাকুলের ভীরুতা ক্রমে বালকদের হৃদয়ে সংক্রামিত হইতেছে। পঞ্চম বর্ষীয় বালক যখন দেখে যে তাহার মাতা পতঙ্গ দর্শনে মূর্ছিত্র হন, তখন কি সে ভাবে না যে পতঙ্গ বাস্তবিকই কোন ভয়ানক বস্তু?

 এইখানে বলিয়া রাখি যে কীট পতঙ্গ দেখিয়া মূর্ছা যাওয়ার দোষে কেবল আমরা দোষী নহি। সুসভ্যা ইংরাজ রমণীও এ অপবাদ হইতে মুক্তি পান না। “গালিভরের ভ্রমণ” নামক পুস্তকে ("Gullivers' Travels”-এ দেখা যায়, যখন ডাক্তার গালিভর “ব্রবডিঙ্গন্যাগ” (Brobdingnag)-দের দেশে গিয়া শস্যক্ষেত্রে সভয়ে বিচরণ করিতেছিলেন, তখন একজন ব্রডিন্যায় তাঁহাকে হাতে তুলিয়া লইয়া আপন স্ত্রীকে দেখাইতে গেল! ইংরাজ-ললনা যেমন কীট পতঙ্গ বা মাকড়সা দেখিয়া ভীত হন, বুবডিঙ্গনাগ রমণীও তদ্রপ ডাক্তার