পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর : প্রথম খণ্ড ৪৫

গালিভরকে দেখিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল!! কারণ দীর্ঘকায়া ব্রবডিঙ্গনব্যাগ রমণী ডাক্তারকে একটি ক্ষুদ্র কীট-বিশেষ মন করিয়াছিল!! তাই বলি পর্দা ছাড়িলেও পতঙ্গ ভীতি দূর হয় না! “

 পতঙ্গ-ভীতি দূর করিবার জন্য প্রকৃত সুশিক্ষা চাই—যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত (brain ও mind cultured) হয়। আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকলপ্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে।

 শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দুরদশী ভাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইহাতে তাহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূর্বেও বলিয়াছি যে “নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না। এখনও তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার বলিব।

 এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই—তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্ব্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর-শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ অমূল্য অলঙ্কার:

“চোরে নাহি নিতে পারে করিয়া হরণ,
 জ্ঞাতি নাহি নিতে পারে করিয়া বণ্টন,
দান কৈলে ক্ষয় নাহি হয় কদাচন,
এ কারণে বলে লোকে বিদ্যা মহাধন।”

 আমি আরো দুই চারি পংক্তি বাড়াইয়া বলি:

অনলে না পারে ইহা করিতে দহন,
সলিলে না পারে ইহা করিতে মগন,
অনন্ত অক্ষয় ইহা অমূল্য রতন,
এই ভূষা সঙ্গে থাকে যাবত জীবন!

 তাই বলি অলঙ্কারের টাকা দ্বারা “জেনানা স্কুলের আয়োজন করা হউক। কিন্তু ভগ্নীগণ যে স্কুল লাভের জন্য সহজে গহনা ত্যাগ করিবেন, এরূপ ভরসা হয় না। দুঃখের কথা কি বলিব, আমার ভগ্নীদিগকে বোধ হয় এক প্রকার গৃহসামগ্রীর মধ্যে গণনা করা হয়! তাই টেবিলুটা যেমন ফুল পাতা দিয়া সাজ্জান হয়; জানালার পর্দাটা যেমন ফুলের মালা, পুঁতির মালা বা ড্রপ অন্য কিছু দ্বারা সাজান হয়, সেইরূপ গৃহিণী আপন পুত্রবধূটিকেও একরাশি অলঙ্কার দ্বারা সাজান আবশ্যক বোধ করিয়া থাকেন! সময় সময় ভ্রাতাগণ