পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০ রোকেয়া রচনাবলী

হায় অসহায়া অবলা! তোমরা নিজের দোষকে “কপালের” দোষ বল বটে, কিন্তু ভুগিবার বেলা তোমরাই স্বকীয় কর্ম্মফল ভুগিতে থাক! তোমাদের দোষ মূর্খতা, অক্ষমতা, দুর্বলতা ইত্যাদি। রমাসুন্দরী বলিলেন, “বেঁচে থাকতে বাধ্য বলে বেঁচে আছি; খেতে হয় বলে খাই—আমাদের সেই সহমরণপ্রথাই বেশ ছিল! গবর্ণমেট সহমরণ প্রথা তুলে দিয়ে বিধার যন্ত্রণা বৃদ্ধি করেছেন।” ঈশ্বর কি রমার কথাগুলি শুনিতে পান না? তিনি কেমন দয়াময়?

 ৬। আমরা একটি রাজবাটী দেখিতে গিয়াছিলাম। অবশ্য রাজার অনুপস্থিতি সময় যাওয়া হইয়াছিল। তিনি উপাধিপ্রাপ্ত রাজা-রাজ্যের বার্ষিক আয় প্রায় ৫০০০০০ টাকা।

 বাড়ীখানি কবি-বণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোেহর। বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে! এক কোণ হইতে রবির একটু ক্ষীণরশি একটি দর্পণ পড়িয়াছিল; তাহার প্রতিরশ্মি চারিদিকে বেলুরের ঝাড়ে প্রতিভাত হইয়া এক অভিনব আলোকরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছে! এক কক্ষে রাজার রৌপ্যনির্মিত পর্যঙ্কখানা মশারী ও শয্যায় পরিশোভিত হইয়া প্রবাসী রাজার অপেক্ষা করিতেছে। পাঠিকা হয়ত বলিবেন, “খাটখানা রাণী ব্যবহার করেন না কেন?” তাহা হইলে সমাগত লোকেরাও লক্ষ টাকার পর্যঙ্কখানা দেখিতে পাইত না যে! বহির্বাটী পরিদর্শন করিয়া আমরা রাণীর মহলে গেলাম।

 রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসজ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধূলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল। রাণীর শয্যাপার্শ্বে কয়েকখানা বাঙ্গালা পুস্তক এলোমেলোভাবে চুড়ান রহিয়াছে।

 রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম। কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরূপ মূর্ত্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূর্ত্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা সুন্দরী (১৬/১৭ বৎসরের বালিকা—পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; অলঙ্কার বলিতে হাতে তিন তিন গাছি বেঙ্কুরের চুড়ি, মাথায় রুক্ষ কেশের জটা—অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে বাণীকে মূর্তিমতী “বিষাদ” বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ। রাণীর নয়ন দুটিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম।

 রাজা সর্বদা বিদেশে, বেশীর ভাগে কলিকাতায় থাকেন। সেখানে তাহার অপ্সরা, বিদ্যাধরীর অভাব হয় না, এখানে রাণী বেচারী চিরবিরহিণী!! বাড়ীতে দাস দাসী, ঠাকুর দেবতা, পুরোহিত ইত্যাদি সবই আছে; আনন্দ কোলাহলও যথেষ্ট আছে, কেবল রাণীর হৃদয়ে আনন্দ নাই! গৃহখানা তঁহার নিকট কারাগার স্বরূপ বোধ হইতেছে। রাণী যেন একদল দাসীসহ নিন কারাবাসদণ্ডভোগ করিতেছেন!! আমাদের সঙ্গী একটি মহিলা জনান্তিকে বলিলেন, “এমন চমৎকার বাড়ী, আর ঘরে এমন পরী যার, তিনি কি সুখে বিদেশে থাকেন!”

 রাণী বাঙ্গালা বেশ জানেন; তিনি কেবল বই পড়িয়া দুর্বহ সময় কাটান। তিনিমিতভাষিণী, বেশী কিছু বলিলেন না, কিন্তু যে দুই একটি কথা বলিলেন, তাহা অতি চমৎকার। আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, “তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি।” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে!