পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ৫১

অন্তঃপুরের ঐ সকল ক্ষতকে নালীঘা না বলিয়া আর কি বলিব? এ রােগের কি ঔষধ ই? বিধবা ত সহমরণ-আকাক্ষা করে; সধবা কি করিবে?

 ৭। “মহম্মদীয় আইন অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্ত্বির উত্তরাধিকারিণী হই “আমাদের বাড়ী”ও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, বাড়ীর প্রকৃত কর্ত্তা স্বামী, পুত্র, জামাত, দেবর ইত্যাদি হন। তাহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ীর মালিক। হকত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কত্রীকে যাহা বুঝায়, অবােধ নিরক্ষর কত্রী তাহাই বুঝেন।

 গৃহকত্রী মােহসেনা স্বীয় জামাতার সহিত কলহ করিয়া দুই এক দিনের জন্য কোন দূর সম্পর্কীয় দেবর কাসেমের বাড়ী যান। এ বাড়ীখানা মােহসেনার পৈতৃক সম্পত্তি সুতরাং ইহা তাহার একান্ত আপন” বস্তু। কীর একমাত্র দুহিতাও মারা গিয়াছেন; তবু তিনি জামাতাকে (দুই চারিজন দৌহিত্রী ইত্যাদি সহ) বাড়ীতে রাখিয়াছেন। এরূপ স্থলে জামাতা জামালকে। শাশুড়ীর আশ্রিত বলা যাইতে পারে। কিন্তু তামাশা দেখুন, মােহসেনা গৃহে ফিরিয়া আসিলে, দ্বারবান তাঁহাকে জানাইল, এ বাড়ীতে তাহার প্রবেশ নিষেধ। তিনি অত্যন্ত ক্রদ্ধা হইয়া বলিলেন—“কি? আমার বাড়ীতে আমারই প্রবেশ নিষেধ? পর্দা কর, আমি (শিবিকা হইতে নাবি।”

 দ্বারবানপর্দা করিতে পারি না, মালিকের হুকুম নাই।

 কত্রী—কে তাের মালিক? একমাত্র মালিক ত আমি!

 দ্বারবান—বেআদবী মাফ হউক; হুজুর কি আমাকে তাঁহার পয়জার হইতে রক্ষা করিতে পারেন? হুজুর ত পর্দায় থাকেন, আমরা জামাল মিয়াকেই জানি। আপনি মালিক, তাহা ত দুনিয়া জানে; কিন্তু আমার প্রতি দয়া করিয়া আপনি ফিরিয়া যান। আপনি এখানে নামিলে গােলামের উপর জুলুম হবে। হুজুরেরও অপমান হওয়ার সম্ভাবনা।

 যাহা হউক, হুজুর ফিরিয়া গেলেন!! তিনি কাসেমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন কি কোন আইন নাই, যাহার দ্বারা আমার বাড়ী আমি দখল করিতে পারি?” কাসেম বলিলেন, “আছে। আপনি নালিশ করুন, আমরা সাহায্য করিব।” ওদিকে জামাল এই নালিশের বিষয় জানিতে পারিয়া কাসেমের নিকট আসিলেন। সবিনয়ে মিষ্ট ভাষায় কাসেমকে বুঝাইলেন, “আজ আপনি যদি আমার শাশুড়ীর সাহায্য করেন, তবে ত অন্তঃপুরিকাদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যদি কখন আপনার এরূপ বিপদ ঘটে তবে কেহ আপনার পরিবারের স্ত্রীলােকদের সাহায্য করিবে, আপনি কি তাহা পসন্দ করিবেন? ভাবিয়া দেখুন, এরূপ হওয়া কি ভাল? মিছামিছি শত্রুতা পাতাইবেন কেন?”

 কাসেম অন্তঃপুরে আসিয়া মােহসেনাকে বুঝাইলেন যে, মামলা মােকদ্দমায় অনেক হেঙ্গাম; ওসব গােলমাল না করাই ভাল। অভাগিনী ক্রোধে, অভিমানে নীরবে দগ্ধ হইতে থাকিলেন!! ঐরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্তু কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়ীতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ