পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর :প্রথম খণ্ড ৫৩

পারে। আমি ত আর তোমার পর নই।” ভগীর মাথা ঠিক ছিল না, নগেন্দ্র যাহা লিখাইলেন তিনি তাহাই লিখিলেন। ভাবিলেন, “অমন চাদ যদি গিয়াছে, তবে আর পোড়ার টাকা থেকে কি হবে? প্রতিভার বিয়ে ত নগেন্দ্র দিবেই। আমি এখন মলে বাচি।” নগেন্দ্র ক্রমে দুই তিনটা কন্যাদায় হইতে মুক্ত হইলেন। কিন্তু প্রতিভার বিবাহের জন্য মোটেই ভাবেন না। তাহার বয়স ১২ বৎসর হইলে সৌদামিনী তাহার বিবাহের জন্য ব্যস্ত হইলেন। তিনি যত তাড়া করেন, নগেন্দ্র ততই বলেন, “বর পাওয়া যায় না!”

 প্রতিভা ১৫ বৎসরের হইল—বিবাহ হইল না। ১০০০০ টাকা দিয়া বর পাওয়া যায় না, একথা কি পাঠিকা বিশ্বাস করেন? প্রতিবেশিনীরা নিন্দা করে, অভিশাপ দেয়, “ছি ছি কেমন মামা!” বলে, হাতে নগেন্দ্রের কি ক্ষতি হয়। পল্লীগ্রামের নিন্দা অপবাদ চপার্শ্বস্থিত শস্যক্ষেত্রেই বিলীন হয়। প্রকাণ্ড পাটক্ষেত্রে বড় বড় শূকর লুক্কায়িত থাকিতে পারে, আর ঐ নিন্দাটুকু লুকাইতে পারিবে না?

 এখন সৌদামিনী দেখিলেন তাঁহার স্বামীর কষ্ট উপার্জিত টাকা দ্বারা নগেন্দ্রের অবস্থা ভাল হইল, কন্যাদের বিবাহ হইল—কেবল তাহারই একমাত্র প্রতিভা কুমারী রহিল!!

 ভগ্নী মানকুমারী বলিয়াছেন:

“কাঁদ তোরা অভাগিনী। আমিও কাদিব,
আর কিছু নাহি পারি, ক’ ফোটা নয়ন বারি
ভগিনী! তোদেরি তরে বিজনে ঢালিব;
যখন দেখিব চেয়ে  অনুঢ়া “প্রাচীনা মেয়ে”
কপালে যোটেনি বিয়ে—তখনি কাঁদিব,
যখন দেখিব বালা   সহিছে সতিনি জ্বালা
তখনি নয়ন জলে বুক ভাসাইব;
সধবা বিধবা প্রায়   পরান্ন মাগিয়া খায়—
দেখিলে কাদিয়া তার যমেরে ডাকিব,
এ তুচ্ছ এ হীন প্রাণ   দিতে পারি বলিদান
তোদেরি কল্যাণে বোন্! কিন্তু কি করিব?
কঁদিতে শকতি আছে, কাঁদিয়া মরিব।”

 আমি কিন্তু তাহার সহিত একমত হইয়া কঁদিবার সুরে সুর মিলাইতে পারিতেছি না। আমার ভগ্নীটি অবশেষে সবখানি শক্তি কেবল “কাঁদিয়া মরিতে ব্যয় করিলেন! বাস! ঐরূপ বিজনে অশ্রু ঢালিয়া ঢালিয়াই ত আমরা এমন অবলা হইয়া পড়িয়াছি।

 আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাত্ম নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই—কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি? কেবল রমণীহৃদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। ঐ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে-ভগ্নীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।