পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২ রোকেয়া রচনাবলী

করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরী কি? ইহাতে যদি খদিজা সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে প্রবীণ মহিলাগণ তঁহার হৃদয়ে স্বামীভক্তির অভাব দেখিয়া নিন্দা করেন, কেহ দুই একটা জীর্ণ পুঁথি (মসলামসায়েলের বঙ্গানুবাদ) দেখাইয়া বলেন, “স্বামী মাথা কাটিলে “আহ বলিতে নাই!” কেহ সুরযােগে আবৃত্তি করিলেন:

“নারীর মাের্শেদ[১] স্বামী সের্তাজ[২] জানিবে।
মাের্সেদের সম নারী পতিকে ভজিবে!”

 যাহা হউক খদিজার দুঃখে সহানুভূতি করিবে, এমন লােকটি পর্যন্ত নাই! ইহাকে নরকযন্ত্রণা ভিন্ন আর কি বলিব? কোন মৌলভী বক্তৃতা (ওয়াজ) করিতে যাইয়া বলিয়াছেন, “স্ত্রীলােকে বেশী গুণা (দোষ) করে; হযরত মেয়ারাজ গিয়া দেখিয়াছেন নরকে বেশীর ভাগে স্ত্রীলােক শাস্তি পাইতেছে।” আমরা কিন্তু এই পৃথিবীতেই দেখিতেছি-কুলকামিনীরা অসহ্য নরকযন্ত্রণা ভােগ করিতেছেন!

 ৮। পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ হইতে কন্যাকে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত কি কি জঘন্য উপায় অবলম্বন করা হইয়া থাকে, তাহা কে না জানে? কোন ভ্রাতা তাহা মুখ ফুটিয়া বলেন নাবলিলে অবলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে যে![৩] সুতরাং সে শােচনীয় কথা আমাদিগকেই বলিতে হইতেছে। কোন স্থলে আফিংখাের, গাজাখাের, নিরক্ষর, চিররােগী বৃদ্ধ-যে মােকদ্দমা করিয়া জমিদারীর অংশ বাহির করিতে অক্ষম এইরূপ লােককে কন্যাদান করা হয়! অথবা ভগ্নীর দ্বারা বিবাহের পূৰ্বেই লা-দাবী লিখাইয়া লওয়া হয় কিম্বা ভগ্নীদিগকে চিরকুমারী রাখা হয়; এবং ভ্রাতৃবধূ ননদদিগকে দাসীর মত ভাবেন! আর যদি কোন পরিবারে পুত্র মােটেই না থাকে, কেবল ডজন, অর্ধ ডজন কন্যাই থাকে,তবে জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর ভাগ্যবান স্বামীটি অবশিষ্ট শ্যালিকা কয়টিকে চিরকমারী রাখিতে চেষ্টা করেন! ইহাই সমাজের নালীঘা!! হায় পিতা মােহাম্মদ (দঃ)! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃসম্পত্তিতে অধিকারিণী করিয়াছ, কিন্তু তােমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্ব্বনাশ করিতেছে!! আহা! “মহম্মদীয় আইন" পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের নহে।

 ৯। নববিধবা সৌদামিনী দুই পুত্র ও এক কন্যাসহ ভ্রাতার আলয়ে আশ্রয় লইয়াছেন। ৯/১০ মাস পরে তাহার (১৫ ও ১২ বৎসরের) পুত্র দুইটি দশ দিনের ভিতর মারা যায়। সৌদামিনীর নিকট ১০০০০ টাকার কোম্পানীর কাগজ ছিল।

 যে সময় বিধবা সৌদামিনী পুত্রশােকে পাগলপ্রায় ছিলেন, সেই সুযােগে (অর্থাৎ বালকদ্বয়ের মৃত্যুর একমাস পরেই) ভ্রাতা নগেন্দ্র ঐ টাকাগুলি র্তাহারই নামে গচ্ছিত রাখিতে ভগ্নীকে অনুরােধ করিলেন। বলিলেন, “স্ত্রীলােকের নামে টাকা জমা থাকলে গােলমাল হ'তে


  1. মাের্শেদ-গুরু।
  2. সের্তাজ-সের—তাজ) মাথার মুকুট, অর্থাৎ মুকুটকুল্য শ্রদ্ধাস্পদ।
  3. স্ত্রীলােকদের দুঃখকাহিনীপূর্ণ একটি প্রবন্ধ কোন উর্দু সংবাদপত্রে প্রকাশের নিমিত্ত দেওয়া হইয়াছিল। সম্পাদক তাহা প্রকাশ করিতে সাহসী হন নাই লিখিলেন যে, এরূপ প্রবন্ধ প্রকাশ করিলে সাধারণ পুরুষসমাজ চটিবেন! সুখের বিষয়, বাঙ্গালা কাগজগুলির যথেষ্ট সৎসাহস আছে, তাই রক্ষা! নচেৎ আমাদের দুঃখের কান্না কাঁদিবার উপায়ও থাকিত না!