পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর : দ্বিতীয় খণ্ড ৬৯

বক্তৃতার গুণে অনেকের হৃদয়ে বিশ্বাসের জ্যোতি প্রদীপ্ত হইল এবং তাহার শিষ্য সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। কিন্তু ইহার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধকতা-বহ্নিও পয়গম্বর সাহেবের বিরুদ্ধে দেশময় প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। বিরোধী দলের হস্তে পয়গম্বর সাহেব যত প্রকার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও নিগ্রহ ভোগ করেন, সাধারণ মানব তাহা কিছুতেই সহ্য করিতে পারিত না।

 বিধর্ম্মী শত্রুগণ পয়গম্বর সাহেবের ভক্ত, বিশ্বাসী লোককে যখন যেখানে দেখিতে পাইত, তমুহূর্তেই হত্যা করিত। কাহারও প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করিত। কাহাকে বা হস্ত পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া সূর্যের দিকে মুখ করিয়া মরুভূমিতে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শয়ান করাইয়া তাহার বক্ষের উপর প্রস্তর চাপা দিয়া বলিত, “তুই মোহাম্মদ ও তাহার আল্লাহকে অস্বীকার কর!” কিন্তু এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁহারা মোহাম্মদের কলেমা পড়িতে পড়িতে অকাতরে প্রাণত্যাগ করিতেন!

 একদা কোন দুরাত্মা জনৈক মুসলমানকে ধরিয়া তাহার দেহ হইতে খণ্ড খণ্ড মাংস কাটিয়া ফেলিতেছিল, আর বলিতেছিল, “এ তুই যদি নিজের পুত্র পরিবারের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ঘরে থাকিতিস, আর তোর স্থলে তোর মোহাম্মদ এইরূপ ছিন্নদেহে ভূমে লুটাইয়া ছটফট করিত তবেই বেশ ভাল হইত!” কিন্তু সেই সত্য ধর্ম্মপ্রাণ মুসলমান মৃত্যু পর্যন্ত এই একই উত্তর দিতেছিলেন, “আমার গৃহ, পুত্র কলত্র—সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, সমুদয় হজরৎ রসুলের পদতলে। উৎসর্গ হউক। আমার সম্মুখে যেন তাহার চরণ কমলে একটি কণ্টকও বিদ্ধ না হয়।”[১]

 অবশেষে বিরোধী শত্রুগণ পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যবর্গকে এত অধিক ক্লেশ। দিতে লাগিল যে, তাহারা শেষে রসুলের ইঙ্গিতে দেশান্তরে গিয়া আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলেন। পয়গম্বর সাহেবের একদল অনুবর্ত্তী যখন শত্রু-তাড়নায় ব্যস্ত হইয়া হাবশ (আবিসিনীয়া) দেশে গেলেন, তখন শত্রুগণও তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সে দেশে উপস্থিত হইল, এবং তত্রত্য খ্রীষ্টান রাজাকে অনুরোধ করিল যে, মুসলমানদিগকে উহাদের হস্তে সমর্পণ করা হউক। রাজা তখন হতভাগ্য প্রবাসীদিগকে ডাকিয়া তাহাদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহারা বলিলেন, “রাজন! আমরা অজ্ঞতা ও মূর্খতার সমুদ্রে নিমগ্ন ছিলাম, আমরা ঘৃণিত পৌত্তলিক ছিলাম; আমাদের জীবন দুর্দান্ত পশুপ্রকৃতি নরপিশাচের ন্যায় নীচ ও জঘন্য ছিল নরহত্যা আমাদের দৈনন্দিন ক্রীড়া ছিল; আমরা জ্ঞানান্ধ, ঈশ্বরদ্রোহী ও ধর্ম্মজ্ঞান বিবর্জিত ছিলাম; পরস্পরের প্রতি স্নেহপ্রীতি বা মনুষ্যত্নের নামগন্ধ আমাদের মধ্যে ছিল না; অতিথি সেবা কিম্বা প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য পালন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম; আমরা ‘জোর যার মুলুক তার ব্যতীত অন্য বিধিনিয়ম জানিতাম না। আমাদের এই ঘোর দুরবস্থার সময় আল্লাহতালা আমাদের মধ্যে এমন একজন মানুষ সৃষ্টি করিলেন—যাহার সত্যতা, সাধুতা এবং সরলতার উজ্জ্বল চিত্র আমাদের হৃদয়পটে অঙ্কিত রহিয়াছে; সেই ব্যক্তি আমাদিগকে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, আল্লাহ এক, সর্ব্ব কলঙ্ক হইতে পবিত্র, কেবল তাহারই উপাসনা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য; আমাদিগকে সত্য অবলম্বন এবং মিথ্যা বর্জন করিতে হইবে; প্রতিজ্ঞা পালনে বিশ্বজগতের প্রাণিবৃন্দের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শনে, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য পালনে যেন বিমুখ না হই; যেন স্ত্রীজাতির প্রতি সদ্ব্যবহার করি,


  1. মিসিস বেশান্ত এখানে দুইটী ঘটনা ভ্রমক্রমে এক বর্ণনার ভিতর ফেলিয়াছেন। অমুসলমানের পক্ষে এইরূপ ভ্রম মার্জনীয় (আল এসলাম-সম্পাদক)