পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮ রোকেয়া রচনাবলী

বেশ জানেন যে, কোন বিজ্ঞ বক্তৃতানিপুণ ব্যক্তি কোন সভা সমিতিতে গিয়া বেশ ঝাড়া দুই ঘণ্টা উৎকৃষ্ট বক্তৃতা প্রভাবে শ্রোতৃবর্গকে মােহিত ও চমৎকৃত করিয়া স্বমতে তাহাদের বিশ্বাস জন্মাইতে পারে—যেহেতু সে সময় লােকে তাহাকে কেবল বক্তৃতা-মঞ্চেই দেখে; তাহার আভ্যন্তরীণ জীবনের অবস্থা কিছু জানে না। কিন্তু ইহা বড় কঠিন, এমনকি অসম্ভব যে নিজের স্ত্রী, কন্যা জামাতা প্রভৃতি অতি নিকটবর্তী আত্মীয়গণ তাহার সত্যতার সাক্ষ্য দান করে—যদি সে ব্যক্তি বাস্তবিক ড্রপ নির্ম্মল ও সত্যপর না হয়। আমাদের মতে ইহারই নাম “পয়গম্বরী” এবং সত্য বলিতে কি এমন বিশ্বব্যাপী জয়লাভ হজরত মসিহের (যীশুর) ভাগ্যেও ঘটে নাই।[১]

 আরবীয় পয়গম্বরের সমুদয় আত্মীয়বান্ধবদের মধ্যে কেবল তাহার পিতৃব্য আবু তালেবই (?) এমন ছিলেন, যিনি কেবল নিজের একগুঁয়ে গোঁড়ামীর জন্য তাঁহার ধর্ম্মমতে (প্রকাশ্যে) বিশ্বাস করেন নাই। তিনি সম্প্রান্ত কোরেশ বংশের দলপতি ছিলেন বলিয়া আপন পুরাতন পৈতৃক ধর্ম্ম বিসর্জন দেওয়া নিজের জন্য মানহানিকর বােধ করিতেন; নতুবা তাঁহার কার্যকলাপে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইত যে, তিনি পয়গম্বরের ধর্ম্মে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন। কারণ তিনি রাসুলেল্লাহকে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছিলেন, “হে পিতৃব্যপ্রাণ! তুমি অসঙ্কোচে আপন কর্তব্য পালন করিতে থাক; আমার জীবদ্দশায় কাহার সাধ্য যে, তােমার দিকে কটাক্ষপাত করে?” একদিন আবু তালেব স্বীয় পুত্র হজরত আলীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাের ধর্ম বিশ্বাস কি? আর তুই মােহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে কি মনে করিস?” হজরত আলী অত্যন্ত সম্মান অথচ উৎসাহের সহিত উত্তর করিলেন, “পিতৃদেব! আমি একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহকেই পূজনীয় মনে করি, এবং মােহাম্মদকে আল্লাহতালার প্রকৃত প্রেরিত বলিয়া মানি। আর এই জন্য পয়গম্বরের সংশ্রব পরিত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইব না!”

 ঈদৃশ উত্তর শ্রবণে পিতার অসন্তুষ্টি হইবারই সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাহা তাে হইল না! বরং তিনি বলিলেন, “পিতৃ-প্রাণ-পুত্তলি! আমি তােমাকে অতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ ও তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে অনুমতি দিতেছি। যেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি তােমাকে সুপথ ছাড়া কুপথে পরিচালিত করিবেন না।”

 নবুয়তের (পয়গম্বরী প্রাপ্তির) তিন বৎসর পর্যন্ত পয়গম্বর সাহেব নীরবে, বিনা আড়ম্বরে আপন মিশনের কার্য্য করিতেছিলেন। সে সময় তাহার প্রতি বিশ্বাসী লােকের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন ছিল। অতঃপর তিনি প্রথমে প্রকাশ্য বক্ততা করিলেন, তাহাতে আল্লাহতালার একত্বের বিষয় অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছিলেন, এবং নরবলিদান, বিলাসিতা ও সুরাপান যে অতি কদর্য্য, তাহাও বিশদরূপে বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন। তাঁহার ঐ


  1. অল্পদিন হইল—মুসলমান গ্রন্থকারগণ ইংরাজী ভাষায় এসলাম-সম্বন্ধে পুস্তক পুস্তিকা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, ইহার পূর্ব্বে ইউরােপে এসলাম সম্বন্ধীয় সমস্ত জ্ঞাতব্যই খ্রীষ্টান মিশনের এজেন্সী হইতে সংগ্রহ করা হইত—কাজেই অজ্ঞ ইউরােপ এসলামের নামে একেবারে শিহরিয়া উঠিত। এই অল্পদিনের চেষ্টায় কিরূপ ফল হইয়াছে, এই বক্তৃতা হইতেই তাহার আভাষ পাওয়া যাইতেছে। লর্ড হেডলি, খাজা কামালুদ্দিন, মিঃ এহয়া-উন-নাসর পর্কিনসন প্রভৃতি মুসলমান লেখকগণের চেষ্টায় ইউরােপীয় পণ্ডিতগণের কিরূপ মত পরিবর্তন হইতেছে, “Islamic Review পত্র পাঠ করিলে তাহা সম্যক অবগত হওয়া যাইতে পারে। আলএসলাম-সম্পাদক।