পাতা:রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম - কান্তিচন্দ্র ঘোষ.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভূমিকা

 ফার্সি আমরা জানি নে, কিন্তু ও ভাষার বড় বড় কবিদের নাম আমাদের সকলেরই নিকট সুপরিচিত। হাফিজ ও সাদীর নাম ভদ্রসমাজে কে না জানে? ওমার খৈয়ামের নাম কিন্তু দু’দিন আগে এদেশে কেউ শোনে নি, এমন কি ফার্সিনবিশেরাও নয়। যদিচ এ যুগের সমজদারদের মতে তিনিই হচ্ছেন ইরানদেশের সব চাইতে বড় কবি।

 আজকের দিনে ওমার যে আমাদের একজন অতিপ্রিয় কবি হয়ে উঠেছেন, সে ইউরোপের প্রসাদে। ওমার প্রায় হাজার বছর আগে পারস্য দেশের নৈশাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তাঁর কবিত্বের খ্যাতি কালক্রমে বৃদ্ধি পাওয়া দূরে থাক্—সাহিত্যসমাজে তাঁর নাম পর্য্যন্ত লুপ্ত হয়ে এসেছিল। কিছুদিন পূর্ব্বে জনৈক ইংরাজ কবি ওমারকে আবিষ্কার করেন, এবং সেই সঙ্গে তাঁর কবিতা ইংরাজিতে অনুবাদ করে ইউরোপের চোখের সমুখে ধরে দেন।

 আকাশ-রাজ্যে একটি নূতন জ্যোতিষ্ক আবিষ্কৃত হলে বৈজ্ঞানিক সমাজ যেমন চঞ্চল ও উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, মনোরাজ্যে এই নব নক্ষত্রের আবিষ্কারে ইউরোপের কবি-সমাজ তেমনি চঞ্চল ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। ফলে এযুগে ইউরোপের এমন ভাষা নেই যাতে ওমারের একাধিক অনুবাদ নেই, ইউরোপের এমন সহর নেই যেখানে এই নবকাব্যরসের ঐকান্তিক চর্চ্চার জন্য একাধিক কাব্যগোষ্ঠী গঠিত হয়নি। এই নব নক্ষত্রের একটি নব উপাসক-সম্প্রদায়ও সে দেশে গড়ে উঠেছিল, শুনতে পাই গত যুদ্ধে সে সম্প্রদায় মারা গেছে। সে যাই হোক সেকালের এসিয়ার কবিতা একালের ইউরোপের হাতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে, এবং আমরাও তার অপূর্ব্ব রস দেখে চমৎকৃত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।

 এ কবিতার জন্ম হৃদয়ে নয়, মস্তিষ্কে। ওমার খৈয়াম ছিলেন একজন মহা পণ্ডিত। তিনি সারাজীবন চর্চ্চা করেছিলেন শুধু বিজ্ঞানের, কাব্যের নয়। অঙ্কশাস্ত্রে ও জ্যোতিষে তিনি সেকালের সর্ব্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত ছিলেন। তিনি এই জ্ঞান-চর্চ্চার অবসরে গুটিকয়েক চতুস্পদী রচনা করেন, এবং সেই চতুস্পদী কটিই তাঁর সমগ্র কাব্যগ্রন্থ। এত কম লিখে এত বড় কবি সম্ভবত এক ভর্ত্তৃহরি ছাড়া আর কেউ কখন হন নি। ভর্ত্তৃহরির সঙ্গে ওমারের আরও এক বিষয়ে সম্পূর্ণ মিল আছে। উভয়েই জ্ঞানমার্গের কবি, ভক্তিমার্গের নন।

 ওমারের সকল কবিতার ভিতর দিয়ে যা ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে মানুষের মনের চিরন্তন এবং সব চাইতে বড় প্রশ্ন:—

কোথায় ছিলাম, কেনই আসা, এই কথাটা জান্‌তে চাই
যাত্রা পুনঃ কোন্ লোকেতে?— * * ”

* * * *
এ প্রশ্নের জবাবে ওমার খৈয়াম বলেন:—

সব ক্ষণিকের, আসল ফাঁকি, সত্য মিথ্যা কিছুই নাই।”

 ওমার যে সেকালের মুসলমান সমাজে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, এবং একালের ইউরোপীয়