পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯০ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-চতুর্থ খণ্ড আশুতোষের দর্শন দান যখন রামচন্দ্র এইরূপ স্বার্থ-সাধনে ব্যগ্র হইয়া পড়িয়াছিলেন, তৎকালে মথুরানাথের আহারাদির সহিত বড় একটা সম্বন্ধ ছিল না; তিনি বাড়ীতে বড় আসিতেন না। একদিন ঐ সময়ে তিনি যদৃচ্ছাক্রমে বাড়ীতে আসিলে, তাহার পত্নী গৃহত্যাগ করিয়া তদীয় অনুগামিনী হইতে ইচ্ছা করিলেন; পতি স্বীকৃত হইলেন না। পত্নী পতি-সদনে দেবরের অন্যায়াচার ও সংসারে নিজের অনাস্থার কথা ব্যক্ত করিলেন। পতি বলিলেন-"তোমার এ সংসার-বিরাগ, আসক্তিরই রূপান্তর। ইহা বৈরক্ত্য নহে, ভোগ-পৃহা বাধা প্রাপ্ত হইলে ঈদৃশ ক্ষণিক বৈরাগ্যের উদয় হইয়া থাকে। যাহারা ইহাকে অনাসক্তিবোধে সংসার ত্যাগ করে, দুদিন পরেই দ্বিগুণ তেজে তাহাদের আসক্তি উপস্থিত হয় এবং তাহারা ভণ্ড বলিয়া পরিগণিত হয়। তুমি এ পথ পরিত্যাগ কর, অন্তৰ্য্যামি আশুতোষের আরাধনা কর-ভাবানুরূপ লাভ হইবে।” সেদিন মথুরানাথ গৃহে রহিলেন। মথুরাথের স্ত্রী তখন প্রৌঢ়বয়স্কা। কিছুদিন পরে এই বয়সে তাহার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পাইল। আর একদিন মথুরানাথ গৃহে আসিলে তাহার পত্নী স্বামীকে একটি স্বপ্নের কথা বলিলেন; তিনি যেরূপে মহাদেবকে নিজ পুত্ররূপে দেখিতে পাইয়াছিলেন, তাহাকে কোলে করিতে গিয়াছিলেন ও তৎকালেই নিদ্ৰাভঙ্গ হইয়াছিল ইত্যাদি বলিলেন । পত্নীমুখে স্বপ্ন-কথা শ্রবণে মথুরানাথ অতি বিক্ষিত হইলেন। বিস্ময়ের কারণ এই যে, ঠিক সেই রাত্রে ধ্যানে বসিয়া মানস নেত্রে তিনি সমুজ্জল সুশুভ্র স্নিগ্ধ-কিরণ খণ্ডের ন্যায় এক তেজঃপুঞ্জ কলেবর ধৃত-ত্রিশূল পুরুষকে, তুষার-ধবল বৃষভাঢ়রূপে স্বসদনে সমুপস্থিত দেখিতে পাইয়াছিলেন। পত্নী-মুখ-শ্রুত বৃত্তান্তে তাই তিনি বিস্মিত হইলেন। মথুরানাথের পত্নী, গর্ভের একাদশ মাসে একটি পুত্র প্রসব করিলেন; দৈবাৎ মথুরানাথ সেদিন গৃহে ছিলেন, তিনি শিশুদর্শনে গিয়া দেখিলেন যে, শিশুর গলদেশ বেষ্টন করিয়া একটি সপও জাত হইয়াছে! শিশুকে দেখিয়া মথুরানাথের মনে না-জানি কি ভাব-তরঙ্গ উথিত হইল, তিনি মুচ্ছিত হইয়া পড়িলেন। মথুরানাথের এই পুত্রের নাম মহাদেবপঞ্চানন । ইহার অভু্যদয়ে এই বংশ পবিত্র হইয়াছে, ধন্য হইয়াছে, মহাদেব পঞ্চাননের কাহিনী আমরা ৪র্থ ভাগে যথা প্রাপ্ত বিবৃত করিব। বালকের জয়াৰ্জ্জন মহাদেবের তিন পুত্র, তন্মধ্যে মেঘনারায়ণ যখন নয়বৎসরের বালক, তখন নবদ্বীপাধিপতি এক ব্যাপারোপলক্ষে কাশী, কাঞ্চী, দ্রাবিড়, মিথিলাদি বহুস্থানের পণ্ডিতবর্গকে নিমন্ত্রণ করেন। বঙ্গদেশীয় পণ্ডিতবর্গের তো কথাই নাই । এই ব্যাপারে মহাদেব পঞ্চাননও নিমন্ত্রিত কয়েকজন শিষ্যসহ নবদ্বীপ যাইতে আদেশ দেন । নয়বৎসরের বালক মেঘ নারায়ণ মাত্র ব্যাকরণ শেষ করিয়াছেন, কিন্তু শিষ্যবর্গের বাকে উৎসাহিত হইয়া বিদেশ গমনে ইচ্ছুক হইলেন। তাহার জননী ভগবতী দেবীর মনে এক ভাবের উদয় হইল, ভাবিলেন এই শিশু সেই পণ্ডিত সভায় গিয়া কি করিবে? ইহার দ্বারা তাহার শ্বশুরের ভুবন বিজয়ী খ্যাতি, তাহার পতির অসীম প্রতিপত্তি কি রক্ষিত হইতে পারবে? ভগবতী পতির নিকট শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন, তন্ত্রে তাহার বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল, তিনি অনেক চিন্তা করিয়া, যাত্রাকালে তন্ত্রোক্ত সিদ্ধ “বিজয় মন্ত্র” পুত্রের জিহবায় লিখিয়া, “বৎস, বিজয়ী হও” এই আশীৰ্ব্বাদের সহিত বিদায় দিলেন ।