পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪০ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ “পরশমণি'র ক্ষণিক দেখা পাইতেন, কিন্তু তাহাতে তাহার তৃপ্তি ঘটে নাই; পরে যখন দেখিলেন যে সে ক্রন্দনের শ্রোতা পাশ্বের বন জঙ্গল মাত্র, যাহার জন্য তাহার প্রাণ আকুলিত, তাহার দর্শন পাইতেছেন না, তখন তদীয় হৃদয় দগ্ধীভূত হইয়া গেল, তিনি সহ্য করিতে না পারিয়া প্রাণ ত্যাগ মানসে জলে ঝাপ দিলেন। সেই সময় এক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটিল, পার্শ্ববৰ্ত্তী অরণ্য হইতে এক গৌরবর্ণ সন্ন্যাসী একতন্ত্রী যন্ত্র বাজাইয়া হরিনাম করিতে করিতে সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। সেই পরম রূপবান সন্ন্যাসী মুহুৰ্ত্ত ব্যাজ ব্যতিরেকে জলে ঝাপ দিয়া পড়িলেন ও বঞ্চিতকে উথোলন করিয়া সেই অশ্বথ তলে লইয়া বসাইলেন। সন্ন্যাসী বলিলেন—“বৎস, তোমার এ কুবুদ্ধি কেন হইল? তুমি যাহার দর্শনের জন্য ব্যাকুল, তাহাকে কি সহজে মিলে? আগে মন্ত্র গ্রহণ কর, তাহার পর সেই মন্ত্রটি এক দিবা রাত্র অবিচ্ছেদে জপ কর, তখন ভাগ্য থাকিলে দেখিতে পাইবে।” এই বলিয়া সন্ন্যাসী তাঁহাকে কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত করিলেন। বালক মন্ত্র পাইয়া গুরুকে প্রণাম করিয়া উঠিতে না উঠিতে, ঘন অরণ্যের অন্তরালে নিমেষ মধ্যে সন্ন্যাসী অদৃশ্য হইয়া পড়িলেন। বঞ্চিত গুরুকে আর কোন কথাই জিজ্ঞাসার অবসর পাইলেন না। তদনন্তর বঞ্চিত অনন্য চিত্তে গুরুদত্ত কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। জপ করিতে করিতে তাহার হৃদয়ে স্মিত বিকশিত-বদন জগন্মোহন মদন মোহনের অনুরূপ জাগিয়া উঠিল, নবীন নারদ-কান্তি রূপ মাধুরীর ধ্যানে তাহার চিত্ত ডুবিয়া গেল। এক দিবা রাত্রি চলিয়া গেল,—ইহার মধ্যে বঞ্চিতের বাহ্য জ্ঞান হয় নাই, উষারে কিরণ বিকাশে কানন ভূমি যখন জাগিয়া উঠিল, পক্ষিকুল অভীষ্টসিদ্ধি কোলাহলে বনস্থলী মুখরিত হইল, তখন ধ্যান ভঙ্গে বঞ্চিত চক্ষুরুমীলন করিলেন। এ কি? বঞ্চিত কি দেখিতে পাইলেন? দেখিলেন যে যাহার হৃদয়ের সেই ভুবন মোহনের রূপে ভুবন ভরিয়া গিয়াছে। বঞ্চিত চক্ষু মুছিলেন, পুনঃ চাহিলেন, তবু সেইরূপ, চক্ষের সমক্ষে সেই বিদ্যুদাম বিজরী তেজোমণ্ডিত নব নীরদ কান্তি অপূৰ্ব্ব মূৰ্ত্তি। বালকের মাথা ঘুরিয়া গেল, বুদ্ধি বিলুপ্ত হইল, বঞ্চিত আর ঠিক থাকিতে পারিলেন না, ছিন্নমূল পাদপের ন্যায় মুর্ভূিত হইয়া ভূপতিত হইলেন। যখন তাহার মূর্খভঙ্গ হইল, তখন দিবা অবসান হইয়াছে, রবি অস্তাচল চূড়া অবলম্বন করিয়াছেন। কিন্তু আজ বনভূমির উপর দিয়া এক অপূৰ্ব্ব বন্যা যেন চলিয়া গিয়াছে, এ স্থলের সকলই যেন কি এক ইন্দ্ৰজাল বশে আশ্চৰ্য্য ভাবাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে। বঞ্চিতের শীর্ষদেশে তরুশাখে বসিয়া তখন পর্যন্ত কোকিল পঞ্চম কণ্ঠে মধু বর্ষণ করিতেছে, সুরভি কুসুমের সুবাস লইয়া গন্ধবক ধীরে বহিতেছে, আর জঙ্গলের হিংস্ৰজন্তু-ব্যাঘ্ৰাদি হিংসা ভুলিয়া তাহার চতুষ্পার্থের নৃত্য করিতেছে। বঞ্চিতের তখন স্পষ্ট জ্ঞান হইয়াছে, বঞ্চিত বুঝিলেন যে, তিনি যে অনুরূপ দুর্লভ রূপ দর্শন করিয়াছেন, তাহা চক্ষের ভ্রম দৃষ্টি নহে, তাহা মস্তক বিকৃতির ফল নহে—দ্রুব সত্য; তাহা না হইলে এই বনস্থলে বৃন্দাবনের ভাব ফুটিয়া উঠিবে কেন? ব্যাঘ্ৰাদি পশু হিংসা বৃত্তি ভুলিয়া চাহিয়া থাকিবে কেন? বঞ্চিত আর তখন অজ্ঞ বালক নহেন—তাহার হৃদয়ে “পূৰ্ব্বসিদ্ধ” জ্ঞানের উদয় হইয়াছে। প্রথমেই তাহার মনে দেশের ধৰ্ম্ম দরিদ্রের কথা জাগিল, হায়! দেশের লোক অবস্তুকে বস্তু জ্ঞান করিয়া কি মোহেই মত্ত রহিয়াছে, বঞ্চিত আর বনে থাকিতে পারিলেন না,—লোকালয়ে—গৃহে চলিলেন।