পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ৯৫ প্রত্যক্ষ করিয়াছিল, তিনি তাহাতে একজন সিদ্ধপুরুষ বলিয়া তথাকার সকলের শ্রদ্ধাভাজন হইয়াছিলেন। তাহার বহু শিষ্য ছিল, সুদূর চট্টগ্রামের চক্রমালার বহু ব্রাহ্মণ তাহার নিকট হইতে দীক্ষা-গ্রহণ করিয়াছিলেন। একদা তিনি শ্ৰীক্ষেত্রে যাত্রা করেন, তখন তাহার ভয়ানক জুর কিন্তু তৎপ্রতি তাহার ভ্রুক্ষেপ ছিল না: অসুস্থ অবস্থাতেই যাইতে প্রবৃত্ত হন ও বহুকষ্টে পুরীতে পৌছেন। যাওয়াকালে ভুলবশতঃ কলিকাতায় তাহার জপমালার ঝোলা হারাইয়া যায়। তিনি যখন নীলাচঙ্গে পৌছেন, তখনও তাহার দেহে জ্বর ছিল, হাটিয়া “দর্শনে” যাইবার শক্তি ছিল না। যখন তিনি ভাবিতেছেন যে কষ্টেশ্রষ্টে পুরী পৌছিয়াও তাঁহার সাধ মিটিল না—দর্শন ঘটিল না, হয়তঃ তাহাকে অন্তিম শয্যাশায়ী হইতে হইবে, তখন হঠাৎ একজন অপরিচিত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কোথা হইতে আসিয়া তাহাকে একরূপ বহন করিয়া লইয়া দর্শন করাইলেন। এই বৃদ্ধের সাহায্যে দুই তিন দিনই তাহার দেবদর্শন ঘটিল, তাহার পরে আর উহাকে আসিতে না দেখিয়া, উনি কে তাহা ভাবিতে ভাবিতে আত্মস্থ হইয়া পড়েন। ইহার সম্বন্ধে তিনি কি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন প্রকাশ নাই, কিন্তু আত্মস্থ হইয়া তাহার হারাণ মালার ঝোলা কোথায় রহিয়াছে জানিতে পারেন, ও ক্ষেত্র হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তনের পরে কথা নির্দেশিত স্থানে উহা পুনঃ প্রাপ্ত হন। শিরোমণির সম্বন্ধে ঈদৃশ বহু কথাই শুনিতে পাওয়া যায়। ভৌলা শাহ ভৌলা শাহের জন্মস্থান শ্রীহট্টের অন্তর্গত রফিনগর পরগণা। ইনি শৈশবে পিতৃ মাতৃহীন হইয়া স্বীয় মাসী কর্তৃক প্রতিপালিত হন। বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহার বিদ্যাশিক্ষার বিশেষ অনুরাগ জন্মে এবং সেই উদ্দেশ্যে ১৫/১৬ বৎসর বয়সে তিনি পশ্চিমে গমন করেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি এক সিদ্ধ ফকিরের সঙ্গ প্রাপ্ত হন; তিনি সেই ফকিরের তামাক সাজিয়া দিতেন । একদা ফকির তাহার অনুষঙ্গিবর্গকে বলেন “শীঘ্রই আমি চলিয়া যাইব, তোমরা কেহ কাছ ছাড়া হইও না।" অতঃপর তাহার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িলে তিনি শয্যাশায়ী হইলেন। অনুষঙ্গিবর্গ অনিদ্রা করিয়া সতর্কভাবে তাহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন । এইভাবে অনেকদিন গেল, শিষ্যবৰ্গ অবিরত অনিদ্রা থাকিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। তাহাদের গুরুভক্তি ক্রমশঃ কমিতে লাগিল। তখন আর সকলে সকল সময় কাছে থাকেন না, পাশ কাটিয়া এড়াইতে পারিলেই সুখী! কিন্তু একজন শিষ্য এই রোগাক্রান্ত হন নাই। অকস্মাৎ এক রাত্রে ফকির শিষ্যগণকে ডাকিলেন, তখন সকলেই নিদ্রিত,—কেহ শুনিলেন না। কিন্তু ভৌলা তখনও ফকিরের সেবার জন্য জাগিয়া রহিয়াছেন; ফকিরের আহবানে তিনি নিকটে উপস্থিত হইলেন। ফকির ভৌলাকে কাছে যাইতে ইঙ্গিত করিলে তিনি নিকটে গেলেন; তখন ফকির তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, “আমি চলিলাম, আমার যা কিছু ক্ষমতা, তাহা তোমাতে সঞ্চারিত হউক, এক্ষণে দেশে যাও।” এই কথাগুলি বলিয়াই ফকির দেহত্যাগ করিলেন। ভৌলা তখন তথা হইতে যাত্রা করিয়া, এক সবেবরাতের দিনে মাসীর গৃহে উপনীত হইলেন। মাসী তাহাকে চিনিতে পারিলেন না, অতিথি বলিয়াই স্থান দিলেন। পরদিন মাসীকে তিনি আত্ম-পরিচয় প্রদান করিলেন । দেশের লোকেরা জানিতে পারিল যে ভৌলা জ্ঞানী ও পীর হইয়া প্রত্যাগমন করিয়াছেন। তখন গ্রামের অনেকেই উপদেশ-প্রাপ্তি প্রত্যাশায় প্রত্যহ তাহার কাছে উপস্থিত হইত, তিনিও তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেন । এই রূপে তথায় এক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হইল। ভৌলা কাহাকেও কোনরূপ অদ্ভুত কাৰ্য্য দেখাইতেন না, বরং তাহা গোপন রাখিতে সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু অবস্থা বিশেষে তাহা সময় সময় প্রকটিত হইয়া পড়িত ।