পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২২ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ গৌরাব্দে (১৩১৪ বাংলা) ২০ শে বৈশাখ তারিখে তিনি ব্রজলাভ করেন। তাহার ভেখ গ্রহণে তদীয় পত্নীও ভেখগ্রহণপূৰ্ব্বক পৃথক গৃহবাসিনী হইয়াছিলেন, তিনিও পরলোক গত হইয়াছেন। রাধাগোবিন্দ পুরকায়স্থ করিমগঞ্জের অন্তর্গত দত্তগ্রামের দত্তবংশীয়গণ অতি সন্ত্রান্ত। এই বংশে রাধাগোবিন্দ পুরকায়স্থের জন্ম ; রাধাগোবিন্দ তত্ৰত্য জমিদার ছিলেন। তিনি পরম ধাৰ্ম্মিক ছিলেন; তাহার বাড়ীতে শ্রীধর, বাসুদেব ও মধুসুদন প্রভৃতি দেববিগ্রহ নিত্য পূজিত হইতেন। তাহার ধৰ্ম্মনিষ্ঠায় আকৃষ্ট হইয়া সন্ন্যাসী রামায়ত প্রভৃতি তাহার বাড়ীতে প্রায়ই আতিথ্য গ্রহণ করিতেন। একদা এক দীর্ঘবাহু গৌরকান্তি মহাতেজা সন্ন্যাসী তাহার গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাজপুত্রের ন্যায় তাহার লাবণ্যদর্শনে ও তদীয় মধুময় ধৰ্ম্মকথা শ্রবণে প্রত্যহ বহুলোক তথায় সমবেত হইত। একদিন তত্ৰত্য রামগোবিন্দ পুরকায়স্থ, জয়গোবিন্দ পুরকায়স্থ প্রভৃতি ভব্যব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হইলে সন্ন্যাসী বলিলেন “এস্থানে আসিবার সময় আমি যে এক অপূৰ্ব্ব বস্তুর দর্শন পাইয়াছি, তাহাই আপনাদিগকে বলিব।” এই বলিয়া সন্ন্যাসী চুপ করিয়া রহিলেন। এস্থলে বলা আবশ্যক যে সন্ন্যাসী আমান্নভোজা ছিলেন দুগ্ধ পর্যন্ত অগ্নিপুষ্ট করিতেন না এবং তিনি সাধনসম্পন্ন ছিলেন। দত্ত গ্রামের লোক তাহার প্রতি শ্রদ্ধাৰিত হইয়া পড়িয়াছিল, এবং তাহাকে “সিদ্ধবাবা" বলিত। তাহারা বাবার কথা শ্রবণ করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিলে তিনি পুনঃ বলিতে আরম্ভ করিলেনঃ—“অত্রত্য গান্দাই নদীর দক্ষিণ তীরে যে একটি প্রাচীন দীর্ঘিকা আছে, উহার মধ্যে এক দেবমূৰ্ত্তি নাম—রঘুনাথ ও বহু মূল দ্রব্যাদি নিমজ্জিত আছে। উহার উত্তরে ও পশ্চিমে সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টীলা সজ্জিত মনোহর স্থান—যোগ সাধনের উপযোগী বলিয়া এস্থানে অবস্থিতিপূৰ্ব্বক কিছুদিন সাধন করিব ইচ্ছা হইয়াছে। সে যাক, একসময়ে আমি মণিপুর রাজবাটীতে উপস্থিত হইয়া দেবালয়ে একা সীতামূৰ্ত্তি পূজিতা হইতেছেন দেখিয়া মহারাজ গম্ভীর সিংহকে “রামশুন্য সীতা কেন” জিজ্ঞাসিলে তিনি বলেন যে তাহার সীতাকুমারী, সময়ে বিবাহ দিতে ইচ্ছা আছে এবং আমি বরপক্ষ হইতে পারিব কি না। মহারাজের বাক্যে স্বীকৃত হইয়া বলিয়া ছিলাম যে পৰ্যটনোপলক্ষে কোথাও সীতাশূন্য রাম দেখিতে পাইলে তাহাকে সংবাদ দিব। মহারাজও তাহাতে স্বীকৃত হন। পূৰ্ব্বোক্ত দীঘীতে যে রামমূৰ্ত্তি দেখিয়াছি, তাহারই সহিত মণিপুররাজের সীতার বিবাহ দিতে চাহি। এই বৃহৎ ব্যাপারে আপনার সাহায্য করিবেন। অর্থ সাহায্য নহে, তাহা আমিই বহন করিব।” রাধাগোবিন্দ প্রমুখ সকলেই আনন্দের সহিত প্রস্তাবের অভিনন্দন করিলেন। যোগসিদ্ধ পুরুষের অনায়ত্ত বিষয় কিছুই নাই; অন্তেয় সিদ্ধি ঘটিলেই দূরস্থধনরত্ন দৃষ্টিপথে পতিত হয়; ইহা তাহারা বিশ্বাস করিতেন। যে দীঘীর কথা বলা গিয়াছে, উহার নাম ঘাঘরা দীঘী। উহার পশ্চিম দিশ্বত্তী টীলায়ও তদুত্তরবত্তী টাংপাড়া গ্রামের পশ্চিমের টালায়, দুইটি আশ্রম নিৰ্ম্মিত হইল; বাবা উভয় স্থানে বা কখন বা রাধাগোবিন্দের বাড়ীতে বাসা করিতে লাগিলেন। একদিন দীঘী হইতে মূৰ্ত্তি উত্তোলনের সংবাদ ঘোষিত হইল, যথাকালে দীর্ঘিকা তীরে বহু কীৰ্ত্তনদল সমবেত হইয়া মধুর কীৰ্ত্তনধ্বনিতে দিক প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল, তাহাতে দীঘীর স্থির জল কম্পিত হইতে লাগিল ও পরে স্ফীত হইয়া উঠিল। যোগের প্রাকাশ্য সিদ্ধিবশে বা যে কারণেই হউক দেখিতে দেখিতে ক্ষুদ্র নৌকাকৃতি আধার সমেত রঘুনাথ বিগ্রহ ভাসিয়া সন্নিকটবৰ্ত্ত হইতে লাগিলেন। নিকটবৰ্ত্ত হইলে বাবা জলে নামিয়া রঘুনাথকে কোলে তুলিয়া লইয়া আসিলেন।