পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপসংহার শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১৬৩ বিষ্ণুপ্রিয়া যাহা হউক, শচীদেবী পুনৰ্ব্বার পুত্রের বিবাহ দিতে ইচ্ছা করিলেন এবং রাজ পণ্ডিত সনাতন মিশ্রের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সহিত পুত্রের বিবাহ দিলেন। এদিকে নিমাই পণ্ডিত পূৰ্ব্বে ন্যায় বিদ্যারসে মত্ত হইলেন—অধ্যাপনা করিতে লাগিলেন। পূৰ্ব্ববঙ্গে যেমন শিক্ষাদানের সহ কীৰ্ত্তন প্রচার চলিত—নামের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যাত হইত, এখানে তাহার কিছুই ছিল না, সে সব যেন কিছুই জানেন না! শচী নববধু ও নিমাইকে লইয়া পুনৰ্ব্বার সুখী হইলেন। এই ভাবে কিছু কাল গত হইলে নিমাই পিতৃকৃত্য ব্যপদেশে গয়াতে গমন করেন। বিষ্ণুপদে পিণ্ডদান করিতে গিয়া তাহার যে আশ্চৰ্য্য ভাবোদয় হয়, তদর্শনে সঙ্গী সকল ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। বিষ্ণ পদ দর্শনে নবদ্বীপের উদ্ধত পণ্ডিত ঈশ্বরানুরাগে উন্মত্ত হইলেন; তাহার নেত্ৰ হইতে অবিরলধারে অশ্রুপাত হইতে থাকে। এই সময় ঈশ্বরপুরী নামক সন্ন্যাসীর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় ও তাহার নিকট হইতে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করেন। কৃষ্ণানুরাগ নিমাইর কৃষ্ণানুরাগ ক্ষণে বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, দেখিয়া গয়াবাসী চমৎকৃত হইল; সঙ্গীগণ চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। এমন ভাবতো মানুষে কেহ কখন দেখে নাই, মানুষের চক্ষে যে এত জল থাকিতে পারে, তাহাও কেহ কল্পনা করে নাই। নিমাই জ্ঞানশূন্য হইয়া কৃষ্ণদৰ্শন মানসে “কৃষ্ণ প্ৰাণধন কোথায়" বলিয়া বৃন্দাবনের মুখে ছুটিলেন। সঙ্গীগণ বহু চেষ্টা করিয়া তাহাকে কিছু স্থির করিলেন ও কোনরূপে গৃহে লইয়া আসিলেন। নবদ্বীপে যে কয়েকজন হরিভক্ত তখন ছিলেন, নিমাই পণ্ডিতের ভাব পরিবর্তনের বাৰ্ত্তা প্রাপ্তে তাহাদের চিত্তে পরম হর্ষ উপজাত হইল; সুখস্পন্দিত চিত্তে তাহারা দেখিলেন যে নিমাই এক অদ্ভুত বস্তু। বিনয়ের আধার, নিজকে নিতান্তহীনজ্ঞান, দম্ভ নাই, অহঙ্কার নাই, আপনাকে গোপনে রাখিতেই ব্যস্ত। মেহের আধার,—এত যে বাহ্যজ্ঞানহারক কৃষ্ণপ্রেম, তবু মাকে দেখিলে সব ভুলে যান, মাতাই তাহার কাছে সাক্ষাৎ ধৰ্ম্মরূপিনী। ভগবৎভক্ত যেন প্রাণের সদৃশ । দয়ার আধার, + দীনহীন দেখিলে নিমাই গলিয়া যান—চক্ষের জল থামে না। ভক্তির আধার,—কৃষ্ণভক্ত দেখিলে বশে থাকেন না, হরিনাম শুনিলে নিমাইয়ের চক্ষুর জলে বক্ষঃ ভাসে। প্রেমের আধার—সৰ্ব্বদা ভগবৎপ্রেমে ভাসিতেছেন, ভিতর হইতে যেন ভাবরাশি উছলিয়া উঠিতেছে। বহুচেষ্টাতেও নিমাই অন্তরের ভাব দর্শন করিয়া রাখিতে পারিতেছেন না। বস্তুতঃ বয়সে নবীন হইলেও নিমাইয়ের আচরণ সকলের শিক্ষনীয় ও আদর্শস্থানীয় হইল; দেখিতে দেখিতে চারিদিক হইতে ঈশ্বরানুরাগী ভক্তগণ আসিয়া নিমাইকে ঘেরিলেন। নিমাইর ছেলে পড়ান বন্ধ হইল, শ্রীবাসের বাড়ীতে কীৰ্ত্তন কোলাহল উঠিল।।১৬ সেই মৃত সঞ্জীবনী বংশীধ্বনী-শ্রবণে বহুদিনের শুষ্কতরু মঞ্জরিত হইল—নিজ্জীব বঙ্গদেশবাসী প্রাণ পাইল । সে সকল অমৃত বাৰ্ত্ত বিস্তারিতরূপে বর্ণনের আমাদের স্থান নাই—শক্তিও না।১৭ ১৬. পূৰ্ব্বে শ্রীবাস পণ্ডিতের কথা প্রসঙ্গে ইহা উল্লেখিত হইয়াছে। ১৭. নিমাই গয়া হইতে আসিয়া সশিষ্য পথে চলিতে চলিতে একদা শ্রীহট্টবাসী রত্নগৰ্ভ আচার্য্যের টোল হইতে শ্ৰীমদ্ভাগবতের শ্লোক ব্যাখ্যা শুনিয়া কৃষ্ণ প্রেমে মুর্ভূিত হইয়া পড়েন। রত্নগর্ভের কথা "ইতিবৃত্তের” ৩য় ভাঃ ১ম খঃ ৩য় অধ্যায়ে বলা গিয়ছে। শ্রীহট্টের শ্রীবাস পণ্ডিতের তাহার কীৰ্ত্তন লীলা চলিত, শ্রীহট্টের রত্নগর্ভে ব্যাখ্যা শ্রবণে প্রথম তদীয় প্রেম প্রকটন, শ্রীহট্টের আচার্য রত্ন গৃহে বাঙ্গালার প্রথম নাটকাভিনয় এবং শ্রীহট্টের মুরারি গুপ্ত কর্তৃক সৰ্ব্বাদে এসব লিখিত হয়; তাহা ভাবিতে ভক্ত শ্রীহট্টবাসীর আনন্দ হয় নাকি?