পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৬৬ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ কেহ মুচ্ছিত হইয়াছিল এবং কেহ কেহ উন্মত্ত হইয়াছিল। ইহা কল্পনার কথা নহে—বাস্তব ঘটনা; গঙ্গাধর নামক একব্যক্তি কেশব ভারতীর মুখে “চৈতন্য" এই নামাদ্ধ শুনিয়া মুচ্ছিত হন ও তৎপরে পাগল হইয়া শুধু “চৈতন্য" শব্দ উচ্চারণ করিতে করিতে সপ্তদিবা গঙ্গার তীরে তীরে ভ্রমণ করেন; এই ব্যক্তি তদবধি “চৈতন্যদাস" নামে খ্যাত হন। এদিকে শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যেরও বাহ্যজ্ঞান নাই, তিনি কৃষ্ণপ্রেমে বিহবল ৷ উন্মত্তবৎ তিনি "মুকুন্দ” "মুকুন্দ" বলিয়া বৃন্দাবনের মুখে ধাবিত হইলেন। নিত্যানন্দাদি পাঁচজন ভক্ত তাহার সঙ্গে ছিলেন, তাহারা দৌড়িয়া অনুষঙ্গে যাইতে পারিতেছেন না। নবীন উদাসীনের জ্ঞান নাই। বৃন্দাবনে যাইতেছেন বলিয়া মনে করিয়া তিনদিন রাঢ়দেশে এদিক ওদিক পরিভ্রমণ করিলেন। তিন দিনের পর তিনি পূৰ্ব্বমুখ হইলেন, তখন নিত্যানন্দ কৌশলে তাহাকে শান্তিপুরে অদ্বৈতগৃহে আনয়ন করিলেন। গঙ্গাদর্শনে সন্ন্যাসীর কিঞ্চিৎ জ্ঞান হইল, তিনি বলিয়া উঠিলেন—“আমি মনে করিয়াছিলাম, যমুনার তীরে আসিয়াছি এ যে গঙ্গা! আমি কোথায়? আমি কি শান্তিপুরে উপস্থিত হইয়াছি?” তখন অদ্বৈত অগ্রসর হইয়া, তাহাকে গৃহে লইয়া গেলেন অদ্বৈতগুহে কীৰ্ত্তন উঠিল— “কি কহব রে সখি আনন্দ ওর, চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর । পাপ সুধাকর যতদুখ দেল, পিয়া মুখ দরশনে তত সুখ ভেলা৷” (বিদ্যাপতি) শান্তিপুরে বাস্তবিকই “আনন্দের ওর” বা সীমা ছিল না। মাত সম্মিলন নবদ্বীপের প্রত্যেকভক্ত আসিয়াছেন, কাটােয়া প্রভৃতি হইতেও বহুলোকের আগমন ঘটিয়াছে, শচীদেবীও আসিয়াছেন; শান্তিপুরে বাস্তবিকই আনন্দের সীমা নাই। বড় দুঃখের পর মা পুত্রকে পাইয়াছেন; মুখে বাক্য নাই, নয়নে জলধারা। পুত্র মাকে বলিলেন—"জননি! কৃষ্ণপ্রেমে পাগল করিয়া আমাকে ঘরের বাহির করিয়াছে, আমাকে—তোমার অবোধ ছেলেকে –মা! ক্ষমা করো।” মা বলিলেন—“বাপ, যাহা করিয়াছ ভালই, তবে আমাদের চিত্তের তত বল নাই, তাই অভিভূত হই। বাপ, কৃষ্ণ তোমার মঙ্গল করুণ!” “কৃষ্ণ মঙ্গল করুণ” বলিতে শচীর মনে আর একটি কথা স্মরণ হইল, ২৫ বৎসর পূৰ্ব্বে যখন তিনি ঢাকা দক্ষিণ গমন করিয়াছিলেন, তখন শাশুড়ী শোভাদেবী তদীয় গর্ভকথা জ্ঞাত হইতে পারিয়াছিলেন এবং বধূকে নবদ্বীপ প্রেরণকালীন, সেই গর্ভজাত সন্তানটিকে একবার ঢাকাদক্ষিণে পাঠাইতে বলিলে, তিনি প্রতিশ্রত হইয়া আসিয়াছিলেন,১৮ মনে হইল— সে প্রতিশ্রুতি তাহার দ্বারা রক্ষা করা হয় নাই । এই কথাটি তাহার মনে হইলে, তিনি ভাবিলেন—“কই, নিমাইকে তো আমি একথা বলি নাই? তাহাকে নয়নের অন্তরালে পাঠাইতে ইচ্ছা হইত না বলিয়া, বলি নাই। নিমাই পূৰ্ব্ববঙ্গে—তথা শ্রীহট্টে গেলেও আমার প্রতিশ্রুতি সাক্ষাৎভাবে রক্ষিত হইতে পারে নাই—সে তো ঢাকাদক্ষিণে যায় নাই, বরগঙ্গা হইতেই ফিরিয়া আসিয়াছে। আমারও গুরুজনের আদেশ রক্ষা করা হয় নাই। আমার এই পাপের ফলেই কি বিধাতা নিমাইকে ঘরের বাহির করিলেন । যাহাকে চক্ষের অন্তরাল করিতে ভয় হইত, তাহাকে গৃহে রাখিতে পারলাম না। যাহা হ’বার হইয়াছে, এক্ষণে আমার দোষে আর যেন আমার ১৮ শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যেদয়াবলী গ্রন্থ দেখ। এই বিষয়টি শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তের উত্তরাংশের ৩য় ভাগ ১ম খণ্ডের ৩য় অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণিত হইয়াছে বলিয়া এস্থলে পুনরুল্লেখ করা গেল না।