পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৭৮
সংকলন

 ধরণী পাঠ করছে কত যুগ থেকে। সেই পাঠ করাটা আমি মনেমনে চেয়ে দেখছি। সুরলোকের বাণী পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে, কণ্ঠের ভিতর দিয়ে, রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্রাণে প্রাণে হল নিশ্বসিত। একটি চিঠির সেই একটিমাত্র কথা— সেই আলো। সেই সুন্দর, সেই ভীষণ; সেই হাসির ঝিলিকে ঝিকিমিকি, সেই কান্নার কাঁপনে ছলছল।

 এই চিঠি পড়াটাই সৃষ্টির স্রোত— যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে, সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ। সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ। কেননা দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না। সৃষ্টি-উৎসের মুখে কী-একটা কাণ্ড আছে, সে এক ধারাকে দুই ধারায় ভাগ করে। বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা ক’রে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরোল, তখনি সেই বীজ পেল তার বাণী। নইলে সে বোবা, নইলে সে কৃপণ, আপন ঐশ্বর্য আপনি ভোগ করতে জানে না। জীব ছিল একা, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল। তখনি তার সেই বিভাগেব ফাঁকের মধ্যে বসল তার ডাক-বিভাগ। ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই। বিচ্ছেদের এই ফাঁক একটা বড়ো সম্পদ; এ নইলে সব চুপ, সব বন্ধ। এই ফাঁকটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা, একটা আকাঙ্ক্ষার টান টন্‌টন্‌ করে উঠল; দিতে-চাওয়াব আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এপারে ওপারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই হলে উঠল সৃষ্টিতরঙ্গ; বিচলিত হল ঋতুপর্যায়— কখনো-বা গ্রীষ্মের তপস্যা, কখনো বর্ষার প্লাবন, কখনো-বা শীতের সংকোচ, কখনো-বা বসন্তের দাক্ষিণ্য।

 একে যদি মায়া বল তো দোষ নেই, কেননা এই চিঠিলিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা; এর আবির্ভাব তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বোঝা যায় না। যাকে চোখে দেখা যায় না