দুঃখদুর্দশার কাহিনি তৈরি করা হয়েছে। স্থিতাবস্থা যাতে অটুট থাকে বর্ণলিঙ্গবিভাজিত সমাজে, সেজন্যে নাস্তিকের মূল আয়ুধ অর্থাৎ যুক্তিবিদ্যাকে নস্যাৎ করার জন্যে এত উৎকট আগ্রহ আস্তিক্যবাদীদের।
আধিপত্যবাদীরা জানে, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ওপর তাদের সব জারিজুরি নির্ভর করে। অতএব শশাষকশ্রেণীর চাহিদা মেটানোর জন্যে আস্তিক্যবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে ওরা প্রতাপের জাল বুনে গেছে। তার মানে, দর্শনের রাজনীতি সম্পর্কে প্রাচীন যুগ থেকেই ওরা খুব ওয়াকিবহাল। কোনো সন্দেহ নেই, প্রবল হিংস্রতা নিয়ে নাস্তিকদের উপর বারবার ঝাপিয়ে পড়েছে আধিপত্যবাদী শক্তি। লোকায়ত সমাজে নাস্তিক্যবাদের যদি কোনো প্রতিপত্তি না থাকত, তাহলে ওই মতবাদ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হত। নানা অজুহাতে পুরনো দিনের সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রতিবেদনগুলি যেহেতু নাস্তিকদের গালমন্দ করেছে, বিদ্বেষের বহর থেকে মনে হয়, নাস্তিক্যবাদ একেবারে উপেক্ষণীয় ছিল না। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ভয় করত ওই মতবাদের শক্তিকে এবং অবশ্যই তার অনুসরণকারীদের। কেননা সমাজবিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা, দধীচির হাড়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন বজ্রের মতে, প্রতাপমত্তেরা দেখতে পেয়েছিল নাস্তিক্যবাদে। তাদের ভয় যে কতটা বেশি ছিল, তার প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গেছে নানা জায়গায়। ন্যূনতম শিষ্টাচারও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রতিপক্ষকে দেখাতে রাজি ছিল না; আস্তিক্যবাদী ভাবাদর্শের উপযোগিতা সম্পর্কে তারা নিজেরাই যে সন্দিহান ছিল—এই হিংস্র বিদ্বেষ আসলে তারই অভিব্যক্তি।
৪
‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে হরিভদ্র নাস্তিকদের ‘শঠ’ বলেছেন। আর, গুণরত্ন ‘তর্করহস্যদীপিকা’ বইতে যা বলেছেন, তার নিবিড় পাঠ থেকে বুঝতে পারি, পৌরসমাজের মূল ভিত্তি অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা নিচ্ছিলেন। নাস্তিকেরা। সাধারণভাবে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে এই প্রতিভাবাদর্শের ফ্রন ও বিকাশ ঘটেছিল; তবে ক্রমশ কিছু কিছু উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিও এতে শামিল হয়েছিলেন। তার মানে, এই প্রতিভাবাদর্শের রাজনৈতিক মাত্রা অস্পষ্ট নয়; তাছাড়া প্রমাণিত হল, পৌর সমাজ সর্বকালে সর্বদেশে রাজনৈতিক সমাজের ভিত্তি। গৌন ধর্মচর্যা আসলে নামেমাত্র ধর্মসংশ্লিষ্ট; মূলত তা প্রতিবাদী জীবনধারার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি। এইজন্যে গুণরত্ন তার শ্রেণীর সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে লিখলেন:‘কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপি কুর্যতে।সমস্ত ধরনের শিষ্টাচারকে লঙ্ঘন করেছে এই অপভাষা। আজকের দিনে এমন অপভাষা-প্রয়োগকে আমরা সাধারণত খিস্তি-খেউড় বলি। অথচ খ্যাতকীর্তি পণ্ডিতেরা বিনা দ্বিধায় সেসব নাস্তিকদের সম্পর্কে প্রয়োগ করেছেন, যেমন মনুসংহিতায় মনু বলেছেন (২: ১১) বেদ ও স্মৃতি-শাস্ত্রে ব্যক্ত ধর্ম অনুসরণ করাই ইহলোক ও পরলোকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপায়। যুক্তিশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যারা একে অপমান করে, সেইসব বেদ-নিন্দাকারী নাস্তিকদের