পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমাদের জানায়। সে মনে মনে কেবলই ভাবতে থাকে কীভাবে সরোয়ার কবিরের কাছে আসল কথাটা পাড়বে। এভাবে অত্যন্ত কৌশলে ইলিয়াস প্রধান কুশীলবের উপর নানাদিক থেকে আলোকসম্পাত করেছেন। এতে পাঠকৃতির রৈখিকতাও এড়ানো গেছে। এবং এক ধরনের অন্তর্নাট্যের আভাস তৈরি হয়েছে। আমরা আরো লক্ষ করি যে ছোটগল্পের স্বভাব-ধর্ম অনুযায়ী ‘যুগলবন্দি’তেও সময়ের বিন্যাস নির্দিষ্ট আকল্পের দ্যোতনা নিয়ে এসেছে। কেননা বয়ানের শুরু রাত পৌনে একটার কাছাকাছি। রাত দেড়টায় কমলালেবু জোগাড় করে আসগর গেছে মাদারবাড়িতে, রাত আড়াইটা নাগাদ সে ফিরে এসেছে সরোয়ার কবিরের বাড়িতে। পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা সকাল পৌনে সাতটায়। তারপর ধীরে ধীরে রোদ যখন ছড়িয়ে পড়ছে লনে, সরোয়ার ও জেসমিনের উচ্চবিত্ত সুলভ জীবন-যাপনের একটা ছবি স্পষ্ট হল। সময়ের আকল্পে যখন দুপুরের আভাস আসে, অল্পক্ষণের জন্যে আসগর ছায়াচ্ছন্নতা থেকে রোদের সীমানায় এসে দাঁড়ায়।

 সে-সময় ক্ষণিকের জন্যে কেন্দ্রীয় কুশীলবের চাপা-পড়া মানুষের মূর্তি হঠাৎ বেরিয়ে আসে। অবশ্য সেই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিগত স্বর্গের বিচ্ছিন্ন অবভাস অটুট থাকে: ‘কাল বিকাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক ফোঁটা হুইস্কি আর কমলালেবুর গোটাচারেক কোয়া ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। রাত্রে মা এত করে মাছ দিয়ে ভাত খেতে বলল। মা দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কী রোগ হচ্ছে কে জানে? ম্যাকডোনাল্ড এ্যাণ্ড রবিনসনের কাজটা পেলে খেয়ে না খেয়ে দিনরাত এখানে পড়ে থাকতে হবে না। কোম্পানির ভালো বাড়ি আছে কুলশিতে। ফার্নিশড বাড়ি। যা যা দরকার সব পাওয়া যাবে। এমনকি ফর্সা, বয়কাট চুল, ডায়াটিং করা, স্লিম, ন্যাকান্যাকা করে কথাকওয়া ১টা বউ পর্যন্ত। কিন্তু তার এই ব্যক্তিগত স্বর্গে ‘কেরানি মেণ্টালিটি সম্পন্ন বাবা কিংবা নিচুতলার খাওয়ার রুচি নিয়ে থাকা মায়ের কোনো স্থান নেই। সে চায় সবাইকে তার ছাঁচে গড়ে তুলতে। কিন্তু সব কিছু ইচ্ছেমতো হয় না বলে নিজেরই উপর অক্ষম ক্রোধে সে হঠাৎ আরগসকে চড় মারার জন্যে বা ঁহাতটা উপরে তোলে। আর, সেই মুহূর্তের বর্ণনায় ইলিয়াস কার্নিভালের হাসিকে উতরোল করে তোলেন: ‘পাগল। সে কি পাগল হয়ে গেলো? বুদ্ধিমানের মতো চট করে ডান হাত দিয়ে নিজের বাম হাতটা নামিয়ে নেয়। ডান হাতের চাপে বাম হাতের কব্জি লাল হয়ে গেলো।’

 এই ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতকে ফিরিয়ে আনা চমৎকার এক প্রতীকী ক্রিয়া। ছোটগল্পের পক্ষে উপযুক্ত এই বাচন। এবং, এরপরই আমরা প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে পৌছে যাই। সময় তখন বিকেল অর্থাৎ কম-বেশি আঠারো ঘণ্টার মধ্যে পাঠকৃতির সাতটি স্তর বিন্যস্ত হয়েছে। নিশ্চয় পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো আসগরের ভেতর-মহলকেও দেখে নেওয়ার জন্যে, কিন্তু সরোয়ার জেসমিনও বাদ পড়ে না। আসগরের মধ্যে আরগসের ছায়া মাঝেমাঝেই জানান দেয়। ইলিয়াস গল্পভাষার

১৭৪