পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করে নেয়। এখানে যেন আসগরের মধ্যে ঘটে গেছে আমূল রূপান্তর; যদিও তা স্থায়ী হয়নি কেননা স্থায়িত্ব অসম্ভব। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। এমনকি, পরাভাষার বিন্যাসেও সূক্ষ্মভাবে শ্রেণীর ছাপ রয়ে যায় মূলত বাচনভঙ্গিতে। এইবার সমগ্র গল্পের প্রেক্ষিতে যদি এই আপাত দলছুট অংশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, গোটা পাঠকৃতি কতকগুলি স্পষ্ট পর্যায়ে বিন্যস্ত। হয়তো বা ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের আকরণের সঙ্গেও এদের তুলনা করা যেতে পারে। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ হয়ে বয়ান যখন সমে পৌঁছেছে, যুগলবন্দির প্রতীতি স্পষ্ট তখন। প্রারম্ভিক উপস্থাপনা থেকে কমলালেবুর খোঁজে নিশুতিরাতে আসগরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত যেন স্থায়ী। তখন বাদী ও সম্বাদী সুরের মতো আসগর ও আরগসের উপস্থিতি এবং আলাপের মতো সরোয়ার কবির সহ বিভিন্ন অনুপুঙ্খ। তারপর বিপরীতের দর্পণে সুরের দ্বিবাচনিকতা প্রতিষ্ঠা করে এই গল্পের অন্তরা অর্থাৎ পরাবাচনে স্পন্দিত বয়ান। ঠিক এর পরের পর্যায়ে নিরালোক বাস্তবের আরেক স্তরের কথাবার্তা। তখন আসগর গাড়ি চালিয়ে গেছে বাড়িতে অর্থাৎ নিজের বাসায়।

 এখানে তার নিজস্ব নরকটিকে আমরা দেখতে পাই যা আসলে তার শ্রেণী-অভিজ্ঞানসূচক প্রেক্ষিত। প্রারম্ভিক অংশের (স্থায়ী) উচ্ছিষ্টজীবী আসগর এখানে (সঞ্চারী) দাপুটে মানু, যে তার নির্ভরশীল মা-বাবার ওপর চোটপাট করে। অর্থাৎ এক মানুষের ভেতরে কত আলাদা আলাদা মানুষ কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে—গল্পকার তা-ই দেখাতে চান। এইজন্যে বাবা-মা সম্পর্কে তার অশ্রদ্ধা চট করে ফনা তুলে ফুসে ওঠে:‘সারাজীবন কিপটেমি করে জমাননা পয়সায় দালান তুলে লোকটার ঘুম কীরকম গাঢ় হয়েছে। রিটায়ার করার পর কাজ নাই কম্ম নাই খালি ঘুমাও, না? দাঁড়াও তোমার ঘুমের ঘোর ঘোচাচ্ছি, দাঁড়াও!' এরপর মায়ের সঙ্গে তার কথাবার্তা এবং নিজের নিত্যদিনকার প্রিয় খাদ্যের মেনু শুনে রাগে দুঃখে তার গা জ্বলে যাওয়া, তার বাবাকে দেখে সরোয়ার কবিরের জাঁদরেল চেহারার বাপের কথা মনে পড়া এবং পরবর্তী কথোপকথন প্রমাণ করে, কীভাবে সীমাবদ্ধ শ্রেণী-অবস্থানের হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠার করছে আসগর। কিন্তু কিছুতেই তার উঞ্ছবৃত্তি কাটিয়ে উঠতে পারে না। সরোয়ারের দেওয়া টাকা থেকে ত্রিশ টাকা বাবাকে দিয়ে সে নিজের বড়োমানুষি চাল অব্যাহত রাখে, জেসমিনের জন্যে কেনা কমলালেবু থেকে এক ডজন সরিয়ে রাখে এবং একটি নিজে খেয়ে নেয়। ভাত খাওয়ার জন্যে মায়ের অনুরোধকে ‘বাঙাল মার্কা কথাবার্তা’ মনে করে সে ভেতরে ফুঁসে ওঠে। জেসমিনের সঙ্গে মায়ের প্রতিতুলনায় তার হীনতাবোেধ জেগে ওঠে বলে সে ক্ষুব্ধ বোধ করে। সে এভাবে আসলে নিজের সামাজিক উৎসকেই অস্বীকার করতে চায়। বাবার পরনে ময়লা বেনিয়ান দেখে দামি স্লিপিং স্যুটের কথা বলে আসগর নিজের কাকতাড়ুয়া মূর্তিকেই স্পষ্ট করে তোলে। আর, এখানেই বয়ানের তৃতীয় পর্যায়টিও শেষ হয়ে যায়।

 চতুর্থ পর্যায়ে আসগর ফিরে আসে সরোয়ার কবিরের ড্রয়িং রুমে। তখন সবাই ঘুমন্ত। নাটকের স্বগত সংলাপের ধরনে আসগর নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা

১৭৩