পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বৈদেশিক শক্তিগুলির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এই মৃগয়াভূমিতে বাস্তব ক্রমশ আরও পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। বিদ্বৎবর্গের চুলচেরা বিশ্লেষণের কোনও তোয়াক্কা করে না এই বহ্নিমান বাস্তব। বাঙালি-অসমীয়া, উপজাতি-অনুপজাতি, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক ধৃতরাষ্ট্রদের কল্যাণে কখনও দাবানল হয়ে দাউ দাউ জ্বলে আর কখনও ছাই চাপা আগুনের মতো ধিকি ধিকি পুড়িয়ে দেয় ধৈর্য ও অধ্যবসায় দিয়ে গড়া সাংস্কৃতিক মিলনায়তনগুলি। সাম্প্রতিক বিদ্যায়তনিক গবেষণায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল সরকারি অনুদান পাওয়ার পক্ষে চমৎকার ‘বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সমাজতত্ত্বে, ভাষাবিদ্যায়, পরিবেশ বিজ্ঞানে, মানবিকী বিদ্যায় নানা প্রকল্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্বৎবর্গ উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ফালা ফালা করে দেখাচ্ছেন। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পিছিয়ে-পড়া বর্গগুলির মধ্যে হঠাৎ-নবাবদের সংখ্যা আশ্চর্যজনক ভাবে বেড়ে গেছে। এঁরাই আবার নবার্জিত অর্থনৈতিক কৌলিন্যকে রাজনৈতিক প্রতাপে রূপান্তরিত করার জন্যে নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠী বা ভাষা-গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, জাতিবৈরের বিষ-বীজাণু ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে কেবলই দেখা যাচ্ছে। চৈতন্যে মড়কের ছবি আর অন্যদিকে মগজ-ধোলাই এর শিকার হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি হচ্ছে।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা স্বভাবত অরাজক মৃগয়াভূমিতে সহাবস্থান-শূন্য অন্ধকূপে স্বেচ্ছাবন্দি। গত একদশক ধরে নবীনতর প্রজন্ম হ্যামলিনের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভারতীয় মানচিত্রের আলোকিত পরিসরে। বিশ্বায়নের উন্মাদনা ভরা আহ্বান পৌছেছে তাদের কাছে এবং ফলে যে-পথ দিয়ে যাচ্ছে তারা, সে-পথ দিয়ে ফিরছে না কেউ। মেধাশূন্য মরুভূমি তৈরি হচ্ছে সর্বত্র, গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। সবার অগোচরে বৈপ্লবিক রূপান্তর ইতিমধ্যে ঘটে গেছে বলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমেধা ও নিম্নমেধাজনদের দাপট বেড়ে গেছে ভয়াবহ ভাবে। চোরাবালির বিস্তার দ্রুত বাড়ছে এখন। তাই পান্থপাদপের বদলে কাঁটাঝোপ আর ক্যাকটাসের বাড়াবাড়ন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে। তবু লেখা হয় কবিতা ও ছোটগল্প: সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার চূড়ান্ত অভাব সত্ত্বেও লেখা হয় মৌলিক নাটক, আঁকা হয় ছবি। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রাগুক্ত ঐ অনেকান্তিক সাংস্কৃতিক বীক্ষা ও বহুত্ববাদী জীবনচর্যার সূক্ষ্ম ও গভীর প্রকাশ কতটুকু দেখতে পাই? মাঝে মাঝে অনুবাদের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী সৃষ্টি- ভুবনকে চিনে নেওয়ার উদ্যম হয়। কিন্তু তা সার্বিক পীড়া উপশমের বিশল্যকরণী তৈরি করার পক্ষে মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

 এ অঞ্চলের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-সব প্রয়াস হয়, তা আসলে সাগরে লহরী সমান। ধারাবাহিক উদ্যম অন্য যে-সব প্রতিষ্ঠান নিতে পারত, তাদের মধ্যে শুধু দেখতে পাই এলিয়ট কথিত ‘Gesture without motion'-এর দৃষ্টান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের অনুবর্তনে আত্মতৃপ্তি থাকতে পারে কিন্তু তাতে সার্বিক বিচ্ছিন্নতায় ক্লিষ্ট উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অন্ধবিন্দু থেকে উদ্ভাসনে উত্তীর্ণ করা যায় না, ইন্দ্রপ্রস্থই হোক অথবা

১৮৩