পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মান্যতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছে? বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে রুচিবিকৃতির উন্মত্ত প্রদর্শনী থেকে সাহস সঞ্চয় করে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যপত্রগুলিও নিজেদের বিজ্ঞাপনের ভাষা পাল্টে দিচ্ছে। স্বভাবত বিজ্ঞাপনী মনস্তত্ত্ব অবধারিত ভাবে এসে পড়ছে সাহিত্যের বয়ানেও। কোনো কিছুতেই কারো এসে যায় না যেন। আসলে রুচিবিকার আধুনিকোত্তর এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অভিজ্ঞান। তাই কিছুদিন আগে হাবেরমাস যে বৈধতাজনিত সংকটের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, ইদানীং সেসব কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে সব কিছু কেননা আমাদের মন এখন জগদ্দল পাথর। সেই পাথরে শ্যাওলা জমতে পারে মাত্র, কোনো রেখার আঁচড় পড়ে। এই আরোপিত মান্যতার ভেতরে বিপুল নিরবয়ব ধূসর শূন্যতা তবু চোখে পড়ে যায় কোনো কোনো কবির। জয় গোস্বামী তাই লেখেন:

 ‘আগুন নিবতে ছাই নেই আর পাথুরে দেওয়াল নেই শুধু দুই দিকে ছড়ানো শূন্য, শুধু দশদিকে ছড়ানো বিরাট একটা কালো দশ দিক, মাঝে মাঝে বিন্দুরা টুপটুপ করে জ্বলছে’ (নর্তক)।

 এ হল নিরালম্ব সময়ের বার্তা যখনকার দস্তুর হল: ‘To lose the original, but find its double, to lose face, but recover one's image, to lose innocence, but recover one's shadow.’ (জাঁ বদ্রিলার: প্রাগুক্ত: ৬৪)

 আজ উপন্যাসকে গিলে খাচ্ছে পপসাহিত্যের আন্তর্জাতিক দানব এবং মেগা-সিরিয়ালের ঝকঝকে ভিস্যুয়াল। ছোটগল্পকে শুষে নিচ্ছে বিনোদনের রগরগে কেচ্ছা আর বিজ্ঞাপনের মায়াবী নাট্য-মুহূর্তের বিন্যাস। শিশুসাহিত্যের সজীব ও সংবেদনশীল বয়ান কার্টুন নেটওয়ার্ক-এর যান্ত্রিকতায় মুছে যেতে বসেছে আজ। ছেলেবেলায় যে-সমস্ত গল্প গাথা, লোকায়ত ঐতিহ্যের মণিমুক্তো, কল্পনার সহজ সৌন্দর্য সাংস্কৃতিক সত্তাকে কুসুমিত করত; আজকের প্রজন্মে তাদের অনুপস্থিতি খুব বেশি প্রকট। শৈশব ও কৈশোরে যাদের মন ফুলের মতো তাজা ও নিষ্কলুষ থাকে, অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের মধ্যে বিকারের সংক্রমণ ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে যৌনতা ও সন্ত্রাসের অন্তর্ঘাত দিয়ে। সাহিত্যের উৎসুক গ্রহীতা হওয়ার যে-প্রক্রিয়া এতদিন শিশুকালেই শুরু হয়েছে, ইদানীং তা ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে আরম্ভ হওয়ার আগেই। সর্বগ্রাসী ভোগ্যপণ্যের মাদকে এবং অন্ধ প্রতিযোগিতার মোহে যে-সব আধ্যাত্মিক মানুষের কাঠামো তৈরি হচ্ছে, তাদের ভয়াবহ বৃত্তবন্দি অবস্থানে সাহিত্য ও শিল্পের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাসের প্রজাতি কল্পবিজ্ঞানের ক্রমোৎকর্ষকে প্রতিষ্ঠিত করছিল। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কালে AXN নামক টিভি চ্যানেল যেভাবে কল্পবিজ্ঞানকে বিকৃত করছে এবং উৎকট করছে বিমানবায়ন প্রক্রিয়াকে কম্পুটার প্রযুক্তির সাহায্যে জান্তবতা-হিংস্রতা-অলৌকিকতার ককটেলে রূপান্তরিত করেছে, তা সরাসরি আমাদের সূক্ষ্ম সংবেদনা, মানবিক ইতিহাস ও

২০