পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এভাবে!’ আমাদের পাঠশালা-মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো শুকিয়ে মরছে। ওখানে যে বাংলায় পড়ানো হয়, ওখানে ছেলেমেয়েদের পাঠালে ওরা আনস্মার্ট হবে। দাঁতে-দাঁত চেপে, চোখ পিটপিট করে ইংরেজি বলবে না, বোম্বাইয়া ফিল্মর্মাকা হিন্দি বলবে না। অতএব অল্প-মাইনেতে ঘানির বলদ হয়ে-যাওয়া মাস্টারমশাই ও দিদিমনিতে ছয়লাপ ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলি। স্কুল? সত্যিই কি এদের স্কুল বলা যায়? না, আসলে এসব ব্যবসাকেন্দ্র। কাদের হাতে পুতুলনাচের সুতো এবং কী তাদের পরিচয়—এসব প্রশ্ন কখনো কারো মনে জাগে না। কত বড়ো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছে মগজ ধোলাইয়ের কারিগরেরা, এ বিষয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। এইসব ‘হেভি স্মার্ট’ শিশু-কিশোরেরা যখন তরুণ-তরুণী হচ্ছে, তাদের প্রকৃত পরিণতি কী হচ্ছে—এই খোঁজখবর কিন্তু নেওয়া হয় না। পরিসংখ্যানের সাহায্যে আরও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, সোনার হরিণের পেছনে ধাবমান আজকালকার আদিখ্যেতাপূর্ণ মা-বাবাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতাই বা কী! যে-কোনো মূল্যে সফল হওয়াই একমাত্র পরমার্থ—এই যারা একচক্ষু হরিণের মতো যাবতীয় পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে পায়ের নিচে পিষে মারছে, তাদের ভবিতব্যই বা কী! বেসরকারিকরণের উন্মত্ত তাণ্ডবে ভেসে গেছে সব কিছু। শিক্ষকের জোব্বা পরে সমাজে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা। এরা এতটাই বেপরোয়া এখন, যে, সকালে ও রাত্তিরে নয় কেবল, দুপুরবেলায়ও পেশাদারি সততাকে প্রকাশ্যে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাড়িতে হাট বসিয়ে দিচ্ছে। একেকজন ছাত্রের পেছনে পাঁচ-ছজন রোবট শিক্ষাব্যবসায়ীর ছায়া। এই নিয়ে নিরেট অভিভাবকদের মধ্যেও প্রতিযোগিতাকার ছেলে-মেয়ে কোন বিষয়ের জন্যে কজনকে রেখেছে। এই ‘রেখেছে’ ক্রিয়াপদটা কানে খট করে লাগে; চাই বা না চাই ‘রক্ষিতা’র অনুষঙ্গ সামাজিক দুঃস্মৃতি থেকে উঠে আসে।

 আর, শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা ন্যক্কারজনক ভূমিকায় নেমে পাক মাখছেন দুহাতে। ভয় দেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের, ‘আমার কাছে না পড়ে অমুকের কাছে পড়লে টাইট দেব।...আমার সঙ্গে বোর্ডে বা ভার্সিটিতে অমুক চন্দ্র তমুকের ব্যবস্থা করা আছে।...নম্বর কমাননা বা বাড়ানো আমার বাঁ-হাতের খেলা। আর তারই সঙ্গে মানানসই চোখাচোখা বাক্যবান প্রয়োগ করা হয় ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে। এরাই আজকের শিক্ষক। তারা জাতির কারিগর বটে, তবে বজ্জাতির। কী শেখে ছাত্রেরা এদের কাছে? শেখে, নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে চারপাশ সম্পর্কে অন্ধ থাকা শেখে, নিজের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে যারা আছে, তারা সবাই অশ্রদ্ধেয়, মনোযোগের অযোগ্য এবং অস্তিত্বশূন্য অবয়ব মাত্র। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা শেখে, তা হল, শিক্ষকের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেহাত ডানহাত ও বাঁ হাতের। তারা শেখে এবং দেখে যে শিক্ষকের আত্মম্ভরী-জোব্বার নিচেই রয়েছে। আসল কাকতাড়ুয়া মূর্তি। এরা যখন ধাপে ধাপে স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা অন্য কোনো বিশিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যায়, তাদের সঙ্গে সংলগ্ন কালো ছায়া ঢেকে ফেলে সব কিছু। এরা চৈতন্যে মড়কের বার্তাবহ হয়ে বিষাক্ত ছত্রাক ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। দ্রুত পচে যেতে থাকে সব কিছু: শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

৩৮