পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাবেননি। বিপুল বৈচিত্র্য সম্পন্ন বাঙালির ভুবনে উপভাষা ও বিভাষার প্রচলন রয়েছে। বেশ কিছু অঞ্চলে। কিন্তু ক কের বাঙালিরা যেভাবে উপভাষাকেন্দ্রিক অস্তিত্ব গড়ে তুলেছেন এবং বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নিজেদের বিড়ম্বনার কারণ নিজেরাই হয়েছেন—এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। ফলে এর সুযোগ কখনো কখনো বিভেদকামী মূখ শয়তানেরা নিয়েছে। আঞ্চলিক প্রভূত্ববাদীদের প্রশ্রয়ে বাংলার প্রতিস্পর্ধী এক বরাকী’ ভাষার প্রস্তাবনা করেছে। উনিশে মে-র চেতনা ইদানীং যেভাবে পুনর্জাগরিত হয়েছে, তাতে আশা করা যায়, এই স্পর্ধিত দুঃসাহস আর কেউ দেখাবে না। কিন্তু এর জন্যে আমরাও কি দায়ি নই অনেকটা! অন্য কোথাও উপভাষা ব্যবহারকারী জনতা মূল ভাষার প্রতি আনুগত্য শিথিল করেনি। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে করে ফেলেছি। নইলে স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-আনুষ্ঠানিক সভায়ও কেন উপভাষা ব্যবহার করি আমরা? আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তো থাকবেই, কিন্তু তাই বলে শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ পদান্বয়ে আমারই ভাষার শিষ্ট চলিত রূপ কেন বলতে পারব না? কেন এই উপত্যকার কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্র-ছাত্রী গবেষক-গবেষিকা আনুষ্ঠানিক সভায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারে উপভাষা আঁকড়ে থাকবেন? উনিশে মে-র শহিদেরা তো সিলেটি বিভাষার জন্যে প্রাণ দেননি, বাংলা ভাষার জন্যেই দিয়েছিলেন। এই অত্যন্ত মৌলিক ও প্রাঞ্জল কথাটি এখানকার উচ্চশিক্ষিত সমাজেও বারবার বুঝিয়ে বলতে হবে কেন? এ কি স্বতঃসিদ্ধ সত্য নয়?

 ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-উত্তরবঙ্গ-বিশ্বভারতী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো উপভাষাভাষীদের প্রাধান্য। কিন্তু সেখানে তো একথা বলারই প্রয়োজন পড়ে না। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ঘরে-বাইরে লড়াই নিজেদের ভাষিক সত্তা ও স্বাতন্ত্র প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। এই সর্বাত্মক লড়াইকে আমরাই কি দুর্বল করে দিচ্ছি না? অথচ আমরা প্রান্তিকায়িত অঞ্চলের মানুষ বলে নিজেদের পিছিয়ে-পড়া অবস্থানকে এগিয়ে-থাকা অঞ্চলের বিদ্যাচর্চার প্রতিস্পর্ধী করে তোলার জন্যে বাড়তি উদ্যম, একমুখিনতা ও অধ্যবসায়ের বড় প্রয়োজন ছিল। বরং নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মেরে চলেছি। আমাদের সংবাদপত্রগুলিতে ভুল বাংলা বানান ও ভুল পদান্বয়ের ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বড় কথা, অসমিয়া-হিন্দি বাক্যাংশ ব্যবহার করে খিচুড়ি ভাষা তৈরি করছি আমরাই। এতে যে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের চতুর বিদূষণের শিকার হচ্ছি, এই সচেতনতা কেন থাকবে না আমাদের? নিচু শ্রেণীতে পাঠ্যবই তৈরির নামে পরিকল্পিত ভাবে বাংলা ভাষার গ্রন্থনাকে শিথিল ও ধ্বস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করার বদলে আমরা, বিশেষ ভাবে সমস্ত স্তরে বাংলা ভাষার শিক্ষক ও শিক্ষিকারা, প্রবাদের ‘কত রবি জ্বলে রে কে বা আঁখি মেলে রে’-এর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছি।

 হ্যাঁ, এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। প্রতিটি স্তরে পাঠ্যসূচিকে সময়োপযোগী ও যুক্তিসম্মত ভাবে পুনর্গঠিত করা হোক। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠদানের নতুন আদর্শ গড়ে তোলা হোক। অভিজ্ঞ শিক্ষাব্রতীরা সমস্ত স্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা,

৪২