পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জগদীশ ভট্টাচার্য এবং এরকম আরও কেউ কেউ। তা হলে কোন অকারণ হীনমন্যতা ও আত্মপ্রতারণার মোহে নিজেদের আকাশকে সঙ্কুচিত করে আমরা বরাক উপত্যকার বাঙালিদের সাহিত্যকর্ম ও সংস্কৃতিপ্রক্রিয়ার জন্যে ছোট মাপের মানদণ্ড তৈরি করি?

 বহু বছর আগে ‘সুরমাপত্যকা সাহিত্য সম্মিলিনী’র সভাপতির অভিভাষণ (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) দিতে গিয়ে ভুবনমোহন দেবশর্মা যেসব কথা বলেছিলেন, সেই প্রতিবেদন পুনঃপাঠ করতে হবে আজ। সেই অভিভাষণের কিছু নির্বাচিত অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি: ‘আমরা বাঙালি। বঙ্গভাষা আমাদের ভাষা। বঙ্গীয় সমাজ আমাদের সমাজ। আমাদের দেহে-দেহে বাঙালির রক্ত প্রবাহিত। আমাদের মস্তিষ্কে-মস্তিষ্কে বাঙালির চিন্তাস্রোত। বঙ্গ-ভারতি! তোমার বিজয়শঙ্খ পতিত সমাজের পাপ-তাপ দূর করুক।...মগধ, মিথিলা, শ্রীহট্ট ও উড়িষ্যায় একদা বাগবীণার একটি মাত্র তার বাজিত। কিরূপে তাহার ব্যত্যয় ঘটিয়াছে, আমাদের সুরমা উপত্যকার কথ্যভাষার দিকে লক্ষ্য করিলে, তাহার কথঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যায়।...সাহিত্যের সমগ্র শক্তি একমাত্র উহার কেন্দ্রস্থলে আবদ্ধ থাকিলে দেশের সর্বত্র সত্বর উহার অভ্যুত্থান ঘটিবে না; আমাদের বিরাট জাতীয় ভাষা ও জাতীয় সাহিত্যের সৃষ্টি হইবে না। আগে ভাষা, পশ্চাৎ সাহিত্য। দুঃখের বিষয়, আমাদের ভাষা ও সাহিত্য লইয়া কিছু দিন পূর্বে একটা সন্দেহবাত্যা বহিয়া গিয়াছে। কোনো কোনো পাশ্চাত্য লেখকের লেখনীমুখে প্রকাশিত হইয়াছিল—শ্রীহট্টের বাগব্যবহার বঙ্গভাষা হইতে স্বতন্ত্র এবং শ্রীহট্টের নিজের কোনো ‘সাহিত্য’ নাই!...বাঙ্গালার প্রত্যেক জেলার শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সমাজের কথোপকথনের ভাষা সর্বাংশে একরূপ নহে।..প্রত্যেক জেলার উচ্চশ্রেণী বা শিক্ষিত সমাজের কথ্যভাষা বঙ্গের আদর্শ ভাষার অনুরূপ; কিন্তু নিম্নশ্রেণীর কথ্যভাষা জেলায় জেলায় কিয়ৎ পরিমাণ বিভিন্ন ছাঁচে গঠিত; শব্দ-প্রয়োগ অপেক্ষা উচ্চারণগত বৈচিত্র্যই অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরের ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে। অশিক্ষিত লোকের কথ্যভাষা হইতে আদর্শ গ্রহণ করিয়া পূর্বকথিত পাশ্চাত্য মনীষীগণের অবলম্বিত প্রণালীতে সিদ্ধান্ত সংস্থাপন করিলে বলিতে পারা যায়, বঙ্গের প্রত্যেক জেলায় এমন কি, জেলার বিভিন্ন অংশে ভাষার বিভিন্ন আদর্শ প্রচলিত।...বিভিন্ন জেলার নিম্নশ্রেণীর কথ্যভাষার বৈচিত্র্য বিদ্যমান থাকিলেও উহারা মূলত অভিন্ন এবং অখণ্ড বঙ্গভূমির সাহিত্যিক ভাষার একই গতিপথ চিরকাল নিয়মিত রহিয়াছে।.ভাষা ও সাহিত্যের সহিত জাতীয়তার একটা দুচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রহিয়াছে।..এই সম্বন্ধটুকু ছিন্নভিন্ন হইতে কেহই সম্মতি দিতে পারেন। অখণ্ড বঙ্গভাষা শতখণ্ডে বিভক্তা হইলে বঙ্গ সাহিত্যের সম্প্রসার খব্বীকৃত হইবে এবং সাহিত্য সাধনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়া যাইবে। আমদের সাহিত্যের ভাষা বাঙ্গালা। উহার ঢাকাই-রঙ্গপুরী শ্রীহট্ট-যশোহরী সংস্করণ নাই। সাহিত্য হইতে সর্বপ্রকার প্রাদেশিকতা সরাইয়া ফেলিয়া অখণ্ড বঙ্গভাষার উপাসনা করাই বঙ্গসাহিত্য সেবকের ধ্রুব লক্ষ্য। বঙ্গভাষার উপাসনায় আমাদিগকে নিম্নলিখিত পাশ্চাত্য মন্ত্রটি স্মরণ রাখিতে

৯৩