পাতা:সাধনা (তৃতীয় বর্ষ, প্রথম ভাগ).djvu/২৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৬. সাধনাগ । একসঙ্গেই কৌতুহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই । আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিম বাবু। বলিষ্টতা এবং সৰ্ব্বলোক হইতে র্তাহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব । আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং র্তাহার মুখশ্ৰী স্নেহের কোমলহাস্তে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেই যে তাহার মুখে উদ্যত খঙ্গের দ্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম তাহ আজ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হই নাই। - সেই উৎসব উপলক্ষ্যে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাড়াইয়া শুনিতেছিলেন । । পণ্ডিত মহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য । করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতী রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সঙ্কুচিত হইয়। দক্ষিণ করতলে মুখের নিম্নাৰ্দ্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্ত ঘরে পলায়ন করিলেন । । বঙ্কিমের সেই সসঙ্কোচ পলায়ন দৃশুটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে। - বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে কোন প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক স্বরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বদ্ধিত হইয়া ইতরতার সেই তাহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমচন্দ্র। | »ب« বোধ রক্ষা করা যে কি আশ্চৰ্য্য ব্যাপার তাহ সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাহার বান্ধব । ছিলেন কিন্তু তাহার লেখায় অন্ত ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিত দেখা যায় না। তাহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইয়া যায় আমাদের মধ্যে র্যাহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাহারা বঙ্কিমের কাছে যে কি চিরঋণে আবদ্ধ তাহ যেন কোন কালে বিস্কৃত না হন। বঙ্কিমের প্রতিভা যদি আমাদের পথ খনন করিয়া না দিত তবে আমরা এত দিনে শিশুপাঠ গ্রন্থের প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ তৃতীয় ভাগ শেষ করিয়া বড় জোর চতুর্থ পঞ্চম ষষ্ঠ ভাগে গিয়! : উপনীত হইতাম । কিন্তু বঙ্গসাহিত্য বয়ঃপ্রাপ্ত হইত না। আজ আমাদের কোন লেখা যদি বয়স্কলোকের পাঠযোগ্য, শিক্ষিত লোকের সমাদরযোগ্য বিদেশীয় ভাষায় অনুবাদযোগ্য হইয়া । থাকে, কোন রচনার একটি অংশও যদি সৰ্ব্বদেশে ও সৰ্ব্বকালে স্থায়ী হইবার উপযোগী সুসম্পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়া থাকে, তাহা অনেকটা পরিমাণে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসাদে। একদিন আমা দের বঙ্গভাষা কেবল একতার যন্ত্রের মত এক তারে বাধা ছিল, ; কেবল সহজ সুরে ধৰ্ম্ম সঙ্কীৰ্ত্তন করিবার উপযোগী ছিল ; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূৰ্ব্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্যস্থর বাজিত আজ তাহ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে।