পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রন্থপরিচয়
২৯৭

প্রাচীন কালে পুত্রশব্দের অর্থ ছিল, যে পূর্ণ করে সেই পুত্র। পুত্রামক কোনাে-একটি নরক হইতে ত্রাণ করে, এই ব্যাখ্যাটি পরবর্তী কালে আমাদের পুরাণে স্থান পাইয়াছে।

 পিতাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলে বলিয়াই পুত্রের গৌরব। পুত্র পিতার অকৃত কর্মগুলিকে সম্পন্ন করে, তাহার ভারকে বহন করে, তাহার ঋণকে পরিশােধ করিয়া দেয়। এই কারণেই, কেবলমাত্র স্নেহপ্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য নহে, কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য, অকৃতার্থতা ও অসমাপ্তি হইতে মুক্তিলাভের জন্যই, পুত্রকে আমাদের দেশে দেবতার বিশেষ প্রদলাভের মতােই গণ্য করিত।

 আমাদের দেশ বহুকাল হইতে পুত্রহীন হইয়া শােক করিতেছে। সে যাহা আরম্ভ করে তাহা কোনাে-একটি ব্যক্তিকেই আশ্রয় করিয়া দেখা দেয় এবং সেই একটি ব্যক্তির সঙ্গেই বিলীন হইয়া যায় তাহার সংকল্পকে বিচিত্র সার্থকতার পরম্পরার মধ্য দিয়া ভাবী পরিণামের দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইবার কোন উপায় নাই। ক্ষুদ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, অসমাপ্তি কেবলই দেশের ঋণের বােঝা বাড়াইয়াই চলিয়াছে; কোনােটাই পরিশােধ হইবার কোনাে সুলক্ষণ দেখা যাইতেছে না।

 এই সম্পূর্ণতাহীন খণ্ডতাশাপগ্রস্ত বন্ধ্যদশা ঘুচাইবার জন্য আমাদের অভাগা দেশ কামনা করিতেছিল। কারণ, বন্ধ্যত্বমাত্রই বন্ধন। যে ব্যক্তি নিজের ফল ফলাইতে পারিল না সে নিষ্কৃতি পাইল কৈ? আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যে অভিপ্রায় রহিয়াছে সেই অভিপ্রায় যদি চারি দিকে সফলতার বিচিত্র রূপ ধারণ করিয়া উঠিতে না থাকে, যদি তাহা কেবল গুপ্তই থাকিয়া যায়, যদি তাহা অঙ্কুরিত হইয়াই শুকাইতে থাকে, তবে এমন কোনাে কৃত্রিম উপায় নাই যাহার সাহায্যে দেশ মুক্তিলাভ করিতে পারিবে। যাহারা নিরন্তর কালের মধ্য দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে দেশের সংকল্পকে সিদ্ধির পথে, মুক্তির পথে লইয়া যাইবে তাহারাই দেশের পুত্র।