পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বসে! আমি স্কুলে ফিরতে ফিরতে জগ্যিদাসকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঐ লোকটা কে রে?” জগ্যিদাস গম্ভীরভাবে বলল, “ঐতো আমার মামা!” আমি বললাম, “সে কি! তোমার মামার ফোটোতে তো দাড়ি ছিল না”- জগ্যিদাস বলল, “আজকাল দাড়ি রেখেছেন।” আমি বললাম, “ফোটোতে তো কালো দেখেছিলাম।” জগ্যিদাস বলল, “এবার দার্জিলিং গিয়ে ফর্সা হয়ে এসেছেন।” আমি ইস্কলে গিয়ে গল্প করলাম, “আজ জগ্যিদাসের মামাকে দেখে এলুম।” জগ্যিদাসও খুব বুক ফুলিয়ে, মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “তোমরা তো ভাই আমার কথা বিশ্বাস কর না। আচ্ছা, নাহয় মাঝে মাঝে দুটো-একটা গল্প বলে থাকি, তা বলে কি আমার সবই গল্প। আমার জলজ্যান্ত মামাকে সুদ্ধ তোমরা উড়িয়ে দিতে চাও?” এ কথায় অনেকেই মনে মনে লজ্জা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে বারবার বলতে লাগল, “আমরা কিন্তু গোড়া থেকেই বিশ্বাস করেছিলাম।”

 তার পর থেকে মামার প্রতিপত্তি ভয়ানক বেড়ে গেল। রোজই সব ব্যস্ত হয়ে থাকতাম মামার খবর শুনবার জন্য। কোনোদিন মামা যেতেন হাতি গণ্ডর বাঘ মারতে। কোনোদিন একাই তিনি পাঁচটা কাবলিকে ঠেঙিয়ে ঠিক করতেন! এইরকম প্রায়ই হত।

 তার পর একদিন সবাই আমরা টিফিনের সময় গল্প করছি, এমন সময়ে হেডমাস্টার মশাই ক্লাশে এসে বললেন, “যজ্ঞদাস, তোমার মামা এসেছেন।” হঠাৎ যজ্ঞদাসের মুখখানা আম্‌সির মতো শুকিয়ে গেল—সে আম্‌তা-আম্তা করে কি যেন বলতে গিয়ে আর বলতে পারল না। তার পর লক্ষী ছেলেটির মতো চুপচাপ মাস্টারমশায়ের সঙ্গে চলল। আমরা বললাম, “ভয় হবে না? জান তো কিরকম মামা!” সবাই মিলে উৎসাহ আর আগ্রহে ‘মামা’ দেখবার জন্য একেবারে ঝুঁকে পড়লাম।

গিয়ে দেখি, একটি রোগা, কালো, ছোকরাগোছের ভদ্রলোক, চশমাচোখে গোবেচারার মতো বসে আছেন। জগ্যিদাস তাঁকেই গিয়ে প্রণাম করল!

সেদিন আমাদের সত্যিসত্যিই রাগ হয়েছিল। এমনি করে ফাঁকি দেওয়া! মিথ্যে করে মামা তৈরি! সেদিন আমাদের ধমকের চোটে জগ্যিদাস কেঁদেই ফেলল। সে তখন স্বীকার করল যে ফোটোটা কোন এক পশ্চিমা পালোয়ানের। আর সেই ট্রেনের লোকটাকে সে চেনেই না। তার পরে কোনো অজিগুবি জিনিসের কথা বলতে হলেই আমরা বলতাম, “জগ্যিদাসের মামার মতো।”

সন্দেশ- শ্রাবণ, ১৩২৩


পাগলা দাশু

আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহার মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে পাগলা দাশুকে চিনিয়া লয়। সেবার একজন নূতন দরোয়ান আসিল, একেবারে আনকোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু

১০৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২