পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বুঝিত এবং সর্বদাই এমন ভাব প্রকাশ করিত যে আমরা তাহার কথাগুলা মানি বা না মানি, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র আসে যায় না। নানারকম খবর ও গল্প জাহির করিবার সময় সে মাঝে মাঝে আমাদের শুনাইয়া বলিত, “অবিশ্যি, কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এ-সব কথা মানবেন না” অথবা “যারা না পড়েই খুব বুদ্ধিমান তারা নিশ্চয়ই এ-সব উড়িয়ে দিতে চাইবেন” ইত্যাদি। ছোকরা বাস্তবিকই অনেকরকম খবর রাখিত। তার উপর তার বোলচালগুলিও ছিল বেশ ঝাঁঝালো রকমের, কাজেই আমরা বেশি তর্ক করিতে সাহস পাইতাম না।

 তাহার পর একদিন কি কুক্ষণে তাহার এক মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া আমাদেরই স্কুলের কাছে বাসা লইয়া বসিলেন। তখন আর সবজান্তাকে পায় কে! তাহার কথাবার্তার দৌড় এমন আশ্চর্যরকম বাড়িয়া চলিল যে, মনে হইত বুঝিবা তাহার পরামর্শ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পুলিশের পেয়াদা পর্যন্ত কাহারও কাজ চলিতে পারে না। স্কুলের ছাত্র মহলে তাহার খাতির ও প্রতিপত্তি এমন আশ্চর্যরকম জমিয়া গেল যে, আমরা কয়েক বেচারী, যাহারা বরাবর তাহাকে নানারকম ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিয়া আসিয়াছি—আমরা একেবারে কোণঠাসা হইয়া রহিলাম। এমন-কি, আমাদের মধ্য হইতে দু-একজন তাহার দলে যোগ দিতে আরম্ভ করিল।

 অবস্থাটা শেষটায় এমন দাঁড়াইল যে স্কুলে আমাদের টেকা দায় হইল। দশটার সময় আমরা কাঁচুমাচু করিয়া ক্লাশে ঢুকিতাম আর ছুটি হইলেই সকলের ঠাট্টা-বিদ্রুপ হাসি-তামাশার হাত এড়াইবার জন্য দৌড়িয়া বাড়ি আসিতাম। টিফিনের সময়টুকু হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের সামনে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো পড়াশুনা করিতাম।

 এইরকম ভাবে কতদিন চলিত জানি না, কিন্তু একদিনের একটি ঘটনায় হঠাৎ সবজান্তা মহাশয়ের জারিজুরি সব এমনই ফাঁস হইয়া গেল যে, তাহার অনেকদিনকার খ্যাতি ঐ একদিনেই লোপ পাইল—আর আমরাও সেইদিন হইতে একটু মাথা তুলিতে পারিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। সেই ঘটনারই গল্প বলিতেছি-

 একদিন শুনা গেল লোহারপুরের জমিদার রামলালবাবু আমাদের স্কুলে তিনহাজার টাকা দিয়াছেন—একটি 'ফুটবল গ্রাউণ্ড’ ও খেলার সরঞ্জামের জন্য। আরো শুনিলাম রামলালবাবুর ইচ্ছা সেই উপলক্ষে আমাদের একদিন ছুটি ও একদিন রীতিমতো ভোজের আয়োজন হয়। কয়দিন ধরিয়া এই খবরটাই আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল। কবে ছুটি পাওয়া যাইবে, কবে খাওয়া এবং কি খাওয়া হইবে এই-সকল বিষয় জল্পনা চলিতে লাগিল। সবজান্তা দুলিরাম বলিল, যেবার সে দাজিলিং গিয়াছিল, সেবার নাকি রামলালবাবুর সঙ্গে তাহার দেখা সাক্ষাৎ এমন-কি, আলাপ পরিচয় পর্যন্ত হইয়া ছিল। রামলালবাবু তাহাকে কেমন খাতির করিতেন, তাহার কবিতা আবৃত্তি শুনিয়া কি কি প্রশংসা করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সে স্কুলের আগে এবং পরে সারাটি টিফিনের সময়, এবং সুযোগ পাইলে ক্লাশের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকেও, নানা অসম্ভবরকম গল্প বলিত। 'অসম্ভব’ বলিলাম বটে, কিন্তু তাহার চেলার দল সে-সকল কথা নির্বিচারে বিশ্বাস করিতে একটুও বাধা বোধ করিত না।

১২০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২